১.
২০১৫ সাল, ৫ ই নভেম্বর।
রবিবার
।
কিরন বসে আছে গ্রামের ছোট্ট নদী ধাঁনসিড়ি নদীর তীরে। পাশে কতোগুলো ইটের টুকরো রাখা। একটু পর পর একটা করে ইটের টুকরা নদীতে ফেলছে সে। আর অবাক হচ্ছে ঢিল গুলো সে নদীতে ফেলছে আর টুপ করে একটা আওয়াজ হয়ে সেটি পানিতে ডুবে যাচ্ছে। কিরন ভাবছে হয়তো মানুষের জীবনও এমটাই। আজ সে এতো বড় ধরনীতে আছে তাই তার এত সোহাগ - যত্ন। কিন্তু সে যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাবে কোনো নাম না জানা দেশের উদ্দেশ্যে তখন হয়তো প্রথম প্রথম অনেকেই মনে করবে কিন্তু এক পর্যায় ভুলেও যাবে সবাই। এসব ভেবেই কিরনের মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আজ রবিবার।
পরশু মঙ্গলবার।
কালিপূজা।
আর সেদিনই আসবে তার প্রানের মানুষ সূর্য ব্যাংকক থেকে। আজ দীর্ঘ ১২ বছর পর আবার তাদের দেখা হবে। মিলন হবে সূর্য কিরনের। বলা যায় এই কালি পূজোয়ই তাদের ভালোবাসার ১৩ বছর পূর্ণ হবে। দেখতে দেখতে কিভাবে যেন কেটে গেল সূর্যকে ছাড়া কিরনের এই বারোটি বছর। কিন্তু এই দুটো দিন যেন কিছুতেই কাটতে চায় না কিরনের। হঠাৎ কিরনের ফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো সূর্য ?
ব্যাংকক থেকে সূর্য ফোন করেছে।
-হ্যা বাবু বলো। কেমন আছো?
-এইতো তোমাকে ছাড়া যেন সময় কাটতেই চায় না। এতোদিন কোমন করে যেন সময় কেটে গেছে। কিন্তু তোমার আসার কথা শোনার পর যেন সময় কাটছেই না।
-আমার সোনা বাবুটা। আমার ময়না কিরনটা আর তো মাত্র দুটো দিন বাবু। তারপর তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও কোনো দিন যাবো না। এবার তোমাকে সঙ্গে নিয়ে তবেই দেশ ছাড়বো।
হঠাৎ কিরনের ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু চেপে গেল। সূর্য ফোনের ওপাশ থেকে ঠিকই বুঝতে পারলো কিরন কাঁদছে।
- কি হয়েছে বাবু?
-কই কিছু নাতো। তুমি আসবা তো তাই খুশিতে চোখে জল চলে এলো।
কিরন চেপে গেল যে সে আর এই দুনিয়ায় খুবই অল্প দিন বেঁচে আছে।
অনেক কথা বার্তার পর ফোনটা রাখা হলো। কিরন ভাবছে এমনই তো কোনো এক কালি পূজোয় সূর্যের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। দ্বীপ নিয়ে এসেছিলো তার জীবনে।।
২০০৩ সাল, অক্টোবরের ২৫ তারিখ, শনিবার।
সন্ধ্যা হতেই কালিপুজোর ধুম পড়ে গেছে। যদিও কালিপূজো মধ্যরাতে। কিন্তু গ্রামের পূজো তো তাই সন্ধ্যা হতেই আরম্ভ হয়ে গেছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। কালিপূজোর দিন সন্ধ্যায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালাতে হয়। তথাকথিত পুরাণে নাকি আছে দেবী এই দ্বীপের আলোয় মন্দিরে আসেন। নিজে খুব কালো কিনা।
কিরনও ব্যাস্ত গ্রামের মন্দিরে দ্বীপ জ্বালানোর কাজে। এদিকে ঢাক, কাশর,ঘন্টা বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রের আওয়াজে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠতে লাগল। কিরন দ্বীপ জ্বালছে এবং ভাবছে সে সমপ্রেমী।
বয়স ১৯।
তার আশা-আকাঙ্খা স্বপ্ন সব একজন পুরুষকে ঘিরেই। কবে আসবে সেই দেবদূত তার জীবনে জ্বলন্ত মোমবাতির ন্যায় দ্বীপ নিয়ে? ধর্মের দিক দিয়েও নাকি এটা অপরাধ। তবুও সে মায়ের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে তার জীবনে যেন কোনো পুরুষই আসে।
হঠাৎ খেয়াল করল মায়ের হাত থেকে একটি জবা ফুল খসে পড়ল কিরনের মাথায়। কিরন খুব খুশি হলো। সে নিশ্চিত হলো তার জীবনে নিশ্চয়ই কেউ আসছে। এবং খুব শিঘ্রই আসছে। কারন কালি মায়ের আশির্বাদ যে সে প্রাপ্ত।
পূজোর তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। এতক্ষনে পূজোর আরতীর সময়ও হয়ে গেছে। কিরন ঠিক করলো সে আজ আরতী দেবে। তাই সে আপন মনে ধূপতী সাজাতে লাগল। কয়েকজন আরতী দেয়া শুরুও করে দিয়েছে। এদিকে ঢাক বাজাচ্ছে পাশের গ্রামের একটি ছেলে। সাদা ফ্রেমের একটা চশমা পড়া। একটি নীল কালো চেকের শার্ট পড়া। সাথে জিন্স। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। কিরন যেন চোখই সরাতে পারছে না। ওর মনে হচ্ছে যেন কোনও স্বর্গের দেবতা মর্ত্যে এসে ঢাক বাজাচ্ছেন। কিন্তু নামটা এখনও অজানা। এতে কিরনের আরও বেশী করে আরতী দিতে ইচ্ছে করছে।
এতক্ষনে কিরনের ধুনুচি সাজানো শেষ। সে শুরু করলো নৃত্য। ঢাকের তালে তালে ধুনুচিচি হাতে সে নাচতে লাগল। প্রায় দেড় ঘন্টা পর একসময় হঠাৎ করে কিরনের হাত থেকে ধূপতীটা পড়ে গেল। কিরনও পড়ে যাচ্ছে ঠিক এই সময় কেউ একজন বলে উঠল সূর্য ওকে ধর। কিরন তো পড়ে যাচ্ছে। পড়ে যেতে যেতে কিরন বুঝল আসলে ঢাকির নাম সূর্য। সূর্য দৌড়ে কিরনের কোমড়টা ধরে ফেলল। কিন্তু দৌড়ে আসার পর নিজের ভার সামলাতেই কষ্ট। তার উপর তো আরেকজনের ভার। তাই কিরনসহ সূর্য মাটিতে পড়ে গেল।
সবাই হাসতে লাগল। কিন্তু সূর্য বা কিরন কারো সেদিকে খেয়াল নেই। তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল একে অন্যের দিকে। অনেক্ষন এভাবে তাকিয়ে রইল তারা। যেন চোখে চোখেই তাদের ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে। মন্ডপী এসে জিজ্ঞাসা করলো কিরে তোদের লাগেনি তো? কিন্তু তাদের ধ্যান ভাঙ্গল না।
মন্ডপী নাড়া দিয়ে বলল কিরে তোরা অমন করে কি দেখছিস একে অন্যের দিকে? কোনো হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকাও তো অমনভাবে চেয়ে থাকে না।
এতক্ষণে তাদের হুঁশ হলো। দুজনেই লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।
-হাই! আমি সূর্য। বলে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
-হ্যালো! আমি কিরন। কিরনও হাতটা বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল।
- বাহ্ ভালোই তো, আপনার নাম সূর্য আর আমি কিরন। অর্থাৎ সূর্যের কিরণ, সূর্যকিরণ। কোথায় থাকেন আপনি?
-এইতো পাশের গ্রামে। আপনি?
-আমার বাড়ী এই পাশেই।
এভাবেই সেদিন পরিচয় হলো দুজনার। সেদিনকার মতো যে যার বাড়ী চলে গেল।
এদিকে অনিমা দেবীর রান্না-বান্না শেষ। সকাল প্রায় নয়টা বাজে। এখনও ছেলেটা ঘুম থেকে উঠল না। তার মা তাকেকে ডাকছে
-কিরে কিরন ওঠ বাবা। নয়টা বেজে গেছে তো। দেখ কে এসেছে।
-কে মা?
-নিজে চোখটা খুলে দেখ না বাবা।
চোখ খুলে কিরন তাকালো।
-একি আপনি?
কিরনের চোখ যেন কপালে ওঠার যোগার।
-আরে সূর্যবাবু আপনি? এতো সকালে? কি মনে করে?
আরে দাড়াও দাড়াও একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর আগে দেব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
তোমরা গল্প করো আমি তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসছি। বলে অনিমা দেবী রান্না ঘরে চলে গেলেন।
২.
-তারপর বলুন কেমন আছেন?
-ভালো। বসতেও বলবে না?
-সরি সূর্য বাবু ভুল হয়ে গেছে। বসুন বসুন।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই। এতো দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে হবে? আরো তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তো। তা তুমি কিসে পড়?
-আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। আপনি?
-আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ার।
এমন সময় অনিমা দেবী চা নিয়ে হাজির হলেন।
চা দিয়ে অনিমা দেবী সূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন আজ প্রথমবার আমাদের বাড়ীতে এসেছো। দুপুরে না খাইয়ে কিন্তু ছাড়ছি না।
-হা হা হা আচ্ছা আন্টি সে দেখা যাবেক্ষন।
আচ্ছা তোমারা থাকো বাবা, চা খেতে খেতে গল্প করো। আমি একটু আসি। বলে চলে গেলেন অনিমা দেবী।
-তোমার বাবা কি করেন কিরন?
এই প্রশ্নে কিরনের চোখ জলে ভিজে গেল। সূর্যের আর বুঝতে বাকি রইল না। তার বাবা ধরনীর মায়া ত্যাগ করে বছর দুয়েক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন দূরে কোথাও।
-আরে এত বড় ছেলে কাঁদে কেন? আমি তো আছি নাকি।
-আপনি? হাসালেন ভাই। আপনি কদিনইবা থাকবেন আমার পাশে? আমি যে অনাথ। বড় একা আমি।
-সূর্য কিরনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল তুমি চাইলে সারা জীবন তোমার পাশে থাকতে রাজি আমি। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি কিরন।
-কি বলছেন এসব আপনি? আর একদিনের পরিচয়ে কি আর ভালোবাসা হয়?
-তুমি চাইলেই হয় কিরন।
বলেই সূর্য আপন বাহুডোরে বেঁধে নিল কিরনকে। আমি তোমাকে নিয়ে সারা জীববন থাকতে চাই কিরন। সুখে-দুঃখে, জীবনে-মরনে একে অন্যের ছায়া হয়ে থাকতে চাই বাবু।
-আমিও যে আপনাকে প্রথম দেখাতেই জীবনের একটা অংশ ভেবে নিয়েছি। আজ আমি বড্ড সুখী সূর্যবাবু।
-হয়েছে হয়েছে এবার আপনি থেকে তুমিতে আসো তো বাপু। আর সূর্যবাবু থেকে শুধু সূর্য। বলে সূর্য কিরকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু এঁকে দিল।
-কি করছেন? দরজা খোলা। মা যেকোনো সময় এসে পড়তে পারেন।
-আবার আপনি?
-ওহ্ সরি! যাও দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।
সূর্য দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় ফিরে আসলো। গালে কিস করলো, ঠোঁটে কিস করলো। ডান হাতটা মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বা হাতটা ক্রমশ নীচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিরনও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সূর্যকে। দুজনেরই শ্বাস ঘন থেকে আরও ঘনতর হয়ে উঠছে। একে একে সব বস্ত্র খুলে ফেলল দুজনে। মেতে উঠল আদিম মানবীয় খেলায়। এ যেন প্রেম নামক রাশলীলে। যেন যা যার সমস্ত শক্তি প্রয়োগেনর প্রচেষ্টা। বহুক্ষণ চলল এভাবে শারীরিক যুদ্ধ। এক পর্যায় যে যার মতো নেতিয়ে পড়ল বিছানার গায়ে।
-কিরে এই অসময় দরজা বন্ধ করলি কেন?
-কি হবে এবার? মা এসে পড়েছেন যে। মা আমি একটু কাপড় চেঞ্জ করছি।
আচ্ছা,,,,,,
তারপর তারা দুপুরে খেয়ে বিকালে বের হলো একটু ঘুরতে। নদীর পারে, গ্রামের কাঁচা রাস্তায় অনেক্ষন ঘুরলো তারা।
এভাবেই একে অন্যের হাত ধরে কেটে গেল বারোটি মাস। কিরন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠল। এদিকে সূর্যের পড়াশুনা শেষ। তাকে এখন যেতে হবে ব্যাংকক। তার মামার কাছে। সূর্যের যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার প্রাণের মানুষ কিরনকে ছেড়ে। কিন্তু আমরা সব সময় যা চাই তা পাই না। মাঝে মাঝে তার উল্টোটাও হয়। আমাদের ভাগ্য যে নিয়তির হাতে বাঁধা। সূর্যের না বোধক কথা শুনে সূর্যের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তাকে যেতে এক রকম বাধ্যই করা হলো। সূর্য কিরনকে এসে সব জানালো।
কিরন কিছু বললো না। শুধু স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। কি করেই বা বলবে সে কথা? তার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। এইতো কদিন আগেও সে একাই ছিলো। অনাথই বলা যায় এক রকম। সূর্য এসে তার জীবনে নিভে যাওয়া প্রদীপটা আবার জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পেয়েছিল সেটা আনন্দাশ্রম। হঠাৎ যেন একটা দমকা হাওয়া এসে দপ করে নিভিয়ে দিচ্ছে তার সুখ প্রদীপটা। ভরা পূর্ণিমার জোৎস্না ভরা চাঁদটা যেন নিমেষেই ঘোর অন্ধকার কালো অমাবশ্যায় ছেয়ে যাচ্ছে তার জীবন নামের আকাশটা। কিরন এক দৌড়ে বাড়ীর ভেতরে চলে গেল। নিজের দরজায় খিল দিয়ে রয়েছে সে ঘরের ভিতর।
অনিমা দেবী এবং সূর্য বাইরে থেকে শত ডাকাডাকি করলো সেদিন কিন্তু দরজা খুললো না। অবশেষে ধাক্কাধাক্কির চোটে দরজা আপন হতেই খুলে গেল।
-এই বোকা বন্ধু বিদেশ যাচ্ছে এতো আনন্দের কথা। তাতে এত কাঁদার কি আছে?
-তুমি একটু বুঝাও তো বাবা। বলে অনিমা দেবী চলে গেলেন। রাত হয়ে গেছে।
-দেখি দেখি আমার বাবুটার মুখখানা একটু দেখি তো। বাবু আমি সারা জীবনের জন্য তো যাচ্ছি না। আমি তো দু'এক বছর পরেই ফিরে আসবো। তারপর তোমাকেও নিয়ে যাবো আমার সাথে। তুমি হাসি মুখে বিদায় না দিলে আমি যাই কি করে বলো তো বাবু?
সেদিন সূর্য কিরনের বাসায়ই থেকে গেল।
অবশেষে ঘনিয়ে এলো সেই দিন। সূর্য যাত্রা করল ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। সেদিনও ছিলো কালি পূজো। কিরন সেদিনও দ্বীপ জ্বেলেছে। হাসি মুখে বিদায় দিল সূর্যকে। কিন্তু সেদিন ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কিরনের ভেতর। বিদায়ের সময় মুখে হাসি ঠিকই ছিলো কিন্তু চোখ কিছুতেই বাঁধ মানছে না। অঝোড় ধারায় ঝড়েছিল সেদিন অশ্রু। হাতে একটা প্রদীপ নিয়ে ঠাঁয় দাড়িয়ে ছিলো কিরন। সূর্যের যাত্রা পথের দিকে।
৩.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিরন এতোক্ষন ভাবছিলো তাদের সুখ-দুঃখের দিন গুলোর কথা। গ্রামের রাস্তা, বাড়ী ফিরতে সমস্যা হতে পারে। বাড়ী ফিরতে হবে। কিরন ধানসিঁড়ি নদীর তীর থেকে উঠে হাটা দিলো বাড়ীর উদ্দেশ্যে। পথে দেখা হলো মায়ের সাথে। অনিমা দেবী খঁজতে বেড়িয়েছেন ছেলেকে। দুপুর হতেই কিরন ঘরে ছিলো না। ছেলেটা যে অসুস্থ। মাকে নিয়ে ঘরে ফিরল কিরন।
-আয় বাবা খেয়ে নে।
-না মা আমার খিদা নেই। খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খাও।
অনিমা দেবী বেশী জোড় করলেন না। আজ বারো বছর ধরেই তো ছেলেটা খাওয়া - দাওয়া ঠিক মতো করছে না। এই একদিনে কি আর এমন ক্ষতি হবে? এমনিতেও তো ছেলেটা বেশীদিন বাঁচবে না। করুক না যা মন চায়।
কিরন অনেক শুকিয়ে গেছে এখন। টানাটানা চোখগুলো যেন গর্তে ঢুকে গেছে। কিরনের হাসিতে এখন আর সেই লাবন্য নেই। বাঁকা হাসিটা ঠোঁটের কোনে এখন আর দেখা যায় না। অনেকেই হয়তো চিনতে পারবে না এখন। আচ্ছা সূর্য কি চিনতে পারবে তাকে? পারবে হয়তো। সে যে ভালোবাসার মানুষ। কিরনের অর্ধাঙ্গ বলা যায়। কিরন আজ আর সেই কিরন নেই। কিরনের এখন ব্রেইন ক্যান্সার। ডাক্তার সব আশা ছেড়ে দিয়ে সবাইকে মন শক্ত রাখতে বলেছে। যে কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। হঠাৎ কিরন চিৎকার দিয়ে উঠল মা বলে। অনিমা দেবীর হাত থেকে বাতিটা পড়ে গেল। দৌড়ে গেল ছেলের ঘরে। কি হয়েছে বাবা? খুব কষ্ট হচ্ছে? কিরন দু হাত দিয়ে কান চেপে ধরে আছে।
-মা মাথায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে মা।
ওষুধ খা বাবা। অনিমা দেবী ওষুধ খাইয়ে দিল। কিরন শুয়ে পড়ল বিছানায়। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সারা রাত মা ঘুমায়নি। জেগে ছিল ছেলের পাশে।
কেটে গেল সেদিন। পরের দিন কালি পূজোর আয়োজন করছে সবাই। কিরনও সবাইকে সাহায্য করছে। সারাদিন কেটে গেল এভাবেই। কিরন আজ খুব খুশি। কারন তার মনের মানুষ আসবে যে কাল। আজ পেট পুরে বহুদিন পর ভাতও খেল কিরন। মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে অনেক গল্প করলো আজ। সবই সূর্যকে ঘিরে। মাও মন দিয়ে শুনছে সব। আর ছেলের অগোচরে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। কিরন ঠিক করলো কাল সে আবার আরতী দেবে। কালই যে তাদের ভালোবাসার তের বছর পূর্ণ হবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মা গেল সন্ধ্যাবাতি জ্বালতে। অমাবশ্যায় কালিপূজো হয়। চারিদিকে অন্ধকার ঘুটঘুটে কালো রাত। কিরন এলো তার ঘরে, বইয়ের পাতার ভিতর দিয়ে একটা ছবি বের করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। সে অনুভব করে এটাই তার সূর্য। মা এলো। দু মা - পোয় মিলে রাতের খাবার খেল। আজ ছেলেকে খুশি দেখে মা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে ঘুমোতে গেল। কিরনও শুয়ে পড়ল।
ঠিক তখনই শুরু হলো আবার যন্ত্রনা। অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলো কিরনের মাথায়। কিন্ত আজ আর কিরন কাউকে ডাকল না। ছবিটা আখড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল চিরতরে।
সকাল প্রায় দশটা বাজে। অথচ আজ কিরন ঘুম থেকে ওঠেনি। কেন? মায়ের মনে শঙ্কা জাগে। গত বারো বছরে তো কিরন এমন করেনি। সে রোজ সকাল ছয়টায় উঠে পড়ে। তার প্রাণ পাখি সূর্য যে তাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে বলেছিল। তাই কিরন রোজ সকালেই ঘুম থেকে উঠত। আজ তো কালি পূজো। কিরনের আজ আরও তাড়াতাড়ি ওঠার কথা। মায়ের মন হঠাৎ ছ্যাত করে ওঠে। মায়ের মাথার ওপর দিয়ে একটি কাক খুব জোড়ে জোড়ে কা কা করতে করতে উড়ে গেল। মা দৌড়ে গেল কিরনের ঘরের দিকে। শাড়ীর পাড়ে পা আটকিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মা। তবুও তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মায়ের। আসলে মায়েরা এমনই হয়। পৃথিবীর সব মায়ের মনই যে এরকম। তবুও সে আবার উঠে ছেলের ঘরের দিকে যায়। কিরন কিরন বলে ডাকে। কিন্তু কিরনের কোনো সারা শব্দ নেই। মা ছেলের নাকে হাত দিয়ে দেখে ছেলে শ্বাস করছে না। অনিমা দেবী চিৎকার দিয়ে ওঠে কিরন কিরন বলে। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। চিৎকার শুনে বাড়ীর সবাই এসে পড়ে। সবাই কিরনের গুন গাইতে থাকে। আসলে এমনটাই হয়। মানুষ মারা গেলেই তার সুনাম বের হয়। অনেক বোঝায় সবাই অনিমা দেবীকে। কিন্তু মায়ের মন তো! কিছুতেই মানে না। সে চিৎকার দিয়ে কাঁদে আর বলে বাবা তুই আমাকে একলা করে দিয়ে কোথায় গেলি রে বাবা। পূজোর বাড়ী আনন্দময় না হয়ে, হয়ে গেছে বিষাদময়।
৪.
আম গাছ কাটা শেষ। বাঁশও কাটা শেষ। মা কেঁদে চলেছেন তখনও। কাঁদছেন সব শুভাকাঙ্খীরা। কিরনকে নতুন কাপড় পড়িয়ে তোলা হলো বাঁশের খাটে। কারো মোবাইলে যেন গান বাজছে,,,,,
"হাতির দাঁতের পালঙ্ক তোর রইবে সবই পড়ে,,,
যাবি যেদিন শ্মশান ঘাটে বাঁশের দোলায় চড়ে,,,,,,,,
"
বাঁশের খাটে করে নিয়ে যাচ্ছে কিরনকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। অনেক বাড়ীতেই শঙ্খের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আজ যে কালি পূজো।
সূর্য বাড়ীর কাছাকাছি এসে গেছে। মনটা খারাপ তার। সকাল থেকেই মনটা কেমন অস্থির। বিমান থেকে নেমে কয়েকশ বার ফোন দিয়েছে সে কিরনকে। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরছে না। হয়তো কিরন রাগ করেছে। বা কোনো সারপ্রাইজ দেবে বলে সে এমনটা করছে। সূর্য ভাবছে।
সূর্য দেখছে অনেক বাড়ীতেই দ্বীপ জ্বালছে। সূর্য একটু হাসলো। কারন এই কালি পূজোর দিনেই দেখা হয়েছিল কিরনের সাথে। হঠাৎ একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল সূর্য। কান্নার শব্দ শোনার পর সূর্যের মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। ট্রলিগুলো সেখানেই ফেলে রেখে ছুট দিলো কান্নার শব্দের দিকে। দেখছে কাকে যেন বাঁশের খাঁটে করে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশান ঘাটের দিকে। পাশে দেখল কিরনের মা এবং তাদের আত্মীয় স্বজন কাঁদছে। সূর্য এগিয়ে গেল কিরনের মায়ের কাছে।
-তুমি এসেছো বাবা? কিরন যে আর নেই।
-নেই মানে? কি সব বলছেন আবোল-তাবোল? কি হয়েছে কিরনের? দেখুন আন্টি আপনি কিছু লুকাবেন না।
-কিরনের মা আর কিছু বলতে পারল না। তার নিরবতাই সব বলে দিচ্ছে।
-আমার কিরনের কিচ্ছু হতে পারে না। আমি হতে দেব না। আপনারা কাকে নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার কিরনকে? নামন! নামন বলছি। এএএই কিরন কি হয়েছে বাবু? এই এই দেখ আমি এসেছি। তোমার সূর্য। তোমার সূর্য তোমাকে এক মূহুর্তের জন্যও ভোলেনি। দেখো বাবু আমি তোমার জন্য কতো কি এনেছি। কি হলো চোখ খুলছো না কেন তুমি? এতো অভিমান? আমি না হয় ক'দিনের জন্য বাইরেই গেছিলাম। কিন্তু রোজ ফোন করে তোমার খবর তো নিয়েছি বলো। কি হলো চোখটা তো খুলবে? কিরন..........
আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি হচ্ছে কিরনের নাম। মনে হয় সেই ডাক ত্রিলোক পেয়ে গেছে। কিন্তু সে ডাক কিরনের কান পর্যন্তু পৌঁছালো না। কিরনের নিথর দেহটা পাথর হয়ে গেছে।
-কেন করলে এটা তুমি? কি দোষ ছিলো আমার? তুমি এটা করতে পারলে? আমাকে একটা করে দিতে পারো না তুমি কিরন। তোমার কোনও অধিকার নেই। জীবনে মরনে একসাথে থাকার পণ করেছিলাম আমরা। কেন ভুলে গেছো সেটা?
সূর্যের এ হেন আর্তনাতে সবাই অবাক হচ্ছে। হয়তো অনেকে ছ্যা ছ্যাও করছে। কিন্তু আজ আর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না সূর্যের।
সূর্য খেয়াল করলো হাতে কিছু একটা আছে কিরনের। হাত থেকে নিয়ে দেখলো নিজের ছবি এবং একটি চিরকুট। এতো কিছুর মাঝেও এটা হাতেই ছিলো কিরনের। যেখানে লেখা ছিলো,,,,,,
-আমি জানি সূর্য এই চিরকুট তোমার হাতেই পড়বে। এই দেখো আমি তোমাকে আমার বুকের ভেতর করে নিয়ে যাচ্ছি। সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি তোমার দেয়া এক বুক ভালোবাসা। আমি চলে যাচ্ছি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে বাঁচতে দিলো না। কিন্তু তোমাকে বাঁচতে হবে। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। কারন তোমার মধ্যেই তো আমি বেঁচে থাকবো। বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের ভালোবাসা। ভালো থেকো তুমি। বাঁচিয়ে রাখো তোমার মধ্যে আমাকে। তুমি যেদিন ব্যাংকক গিয়েছিলা আমি সেদিন তোমাকে হাসি মুখে বিদায় দিয়েছিলাম। আজ যে তোমার পরীক্ষা সূর্য। দাও আমাকে হাসি মুখে বিদায় দাও ধরণীর বুক থেকে.........
ইতি
তোমার কিরণ
সূর্য চিৎকার দিয়ে কিরনের বুকে ঢলে পড়ল। যে প্রদীপ শিখা একদিন তোমার জীবনে আমি জ্বেলেছিলাম তা তুমি নিভিয়ে দিয়ে কোন পথে যাত্রা করলা কিরন? আমার জীবন প্রদীপটাও তো নিভে যাবে তুমি বিহনে। তোমার দ্বীপযাত্রা হয়ে গেছে আজ মরনযাত্রা সেটা এখন শ্মশান যাত্রা।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখুন। সমকাম জগতে সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। ওরা পেয়েছিল, কিন্তু তা তাদের ভাগ্যে সইল না। কই ওদের তো কোনো দোষ ছিলো না। দিতে চায়নি কেউ কাউকে ধোকা। তবে কেন ভাগ্য ওদের নিয়ে এই জঘন্য খেলা খেলল? নিয়তি সবই নিয়তি। বিধির বিধান খন্ডায় কোনজন। অকালে ঝড়ে পড়লো একটি নিষ্পাপ ফুলের মতো প্রাণ। অকালে মৃত্যু হলো একটি পবিত্র ভালোবাসার। নিভে গেল কিরনের জীবন প্রদীপটা। এখন হাজার চেষ্টা করলেও আর সেই দ্বীপ জ্বালানো সম্ভব হবে না। আমি গেয়ে উঠি,,,,,,,,,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,,, (২)
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ী ধরতে পারলে মন বেড়ী,,
দিতাম পাখির পায়,,,,,, কেমনে আসে আসে যায়।
খাঁচার ভিতর.................
( শুভম )
২০১৫ সাল, ৫ ই নভেম্বর।
রবিবার
।
কিরন বসে আছে গ্রামের ছোট্ট নদী ধাঁনসিড়ি নদীর তীরে। পাশে কতোগুলো ইটের টুকরো রাখা। একটু পর পর একটা করে ইটের টুকরা নদীতে ফেলছে সে। আর অবাক হচ্ছে ঢিল গুলো সে নদীতে ফেলছে আর টুপ করে একটা আওয়াজ হয়ে সেটি পানিতে ডুবে যাচ্ছে। কিরন ভাবছে হয়তো মানুষের জীবনও এমটাই। আজ সে এতো বড় ধরনীতে আছে তাই তার এত সোহাগ - যত্ন। কিন্তু সে যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাবে কোনো নাম না জানা দেশের উদ্দেশ্যে তখন হয়তো প্রথম প্রথম অনেকেই মনে করবে কিন্তু এক পর্যায় ভুলেও যাবে সবাই। এসব ভেবেই কিরনের মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আজ রবিবার।
পরশু মঙ্গলবার।
কালিপূজা।
আর সেদিনই আসবে তার প্রানের মানুষ সূর্য ব্যাংকক থেকে। আজ দীর্ঘ ১২ বছর পর আবার তাদের দেখা হবে। মিলন হবে সূর্য কিরনের। বলা যায় এই কালি পূজোয়ই তাদের ভালোবাসার ১৩ বছর পূর্ণ হবে। দেখতে দেখতে কিভাবে যেন কেটে গেল সূর্যকে ছাড়া কিরনের এই বারোটি বছর। কিন্তু এই দুটো দিন যেন কিছুতেই কাটতে চায় না কিরনের। হঠাৎ কিরনের ফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো সূর্য ?
ব্যাংকক থেকে সূর্য ফোন করেছে।
-হ্যা বাবু বলো। কেমন আছো?
-এইতো তোমাকে ছাড়া যেন সময় কাটতেই চায় না। এতোদিন কোমন করে যেন সময় কেটে গেছে। কিন্তু তোমার আসার কথা শোনার পর যেন সময় কাটছেই না।
-আমার সোনা বাবুটা। আমার ময়না কিরনটা আর তো মাত্র দুটো দিন বাবু। তারপর তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও কোনো দিন যাবো না। এবার তোমাকে সঙ্গে নিয়ে তবেই দেশ ছাড়বো।
হঠাৎ কিরনের ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু চেপে গেল। সূর্য ফোনের ওপাশ থেকে ঠিকই বুঝতে পারলো কিরন কাঁদছে।
- কি হয়েছে বাবু?
-কই কিছু নাতো। তুমি আসবা তো তাই খুশিতে চোখে জল চলে এলো।
কিরন চেপে গেল যে সে আর এই দুনিয়ায় খুবই অল্প দিন বেঁচে আছে।
অনেক কথা বার্তার পর ফোনটা রাখা হলো। কিরন ভাবছে এমনই তো কোনো এক কালি পূজোয় সূর্যের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। দ্বীপ নিয়ে এসেছিলো তার জীবনে।।
২০০৩ সাল, অক্টোবরের ২৫ তারিখ, শনিবার।
সন্ধ্যা হতেই কালিপুজোর ধুম পড়ে গেছে। যদিও কালিপূজো মধ্যরাতে। কিন্তু গ্রামের পূজো তো তাই সন্ধ্যা হতেই আরম্ভ হয়ে গেছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। কালিপূজোর দিন সন্ধ্যায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালাতে হয়। তথাকথিত পুরাণে নাকি আছে দেবী এই দ্বীপের আলোয় মন্দিরে আসেন। নিজে খুব কালো কিনা।
কিরনও ব্যাস্ত গ্রামের মন্দিরে দ্বীপ জ্বালানোর কাজে। এদিকে ঢাক, কাশর,ঘন্টা বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রের আওয়াজে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠতে লাগল। কিরন দ্বীপ জ্বালছে এবং ভাবছে সে সমপ্রেমী।
বয়স ১৯।
তার আশা-আকাঙ্খা স্বপ্ন সব একজন পুরুষকে ঘিরেই। কবে আসবে সেই দেবদূত তার জীবনে জ্বলন্ত মোমবাতির ন্যায় দ্বীপ নিয়ে? ধর্মের দিক দিয়েও নাকি এটা অপরাধ। তবুও সে মায়ের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে তার জীবনে যেন কোনো পুরুষই আসে।
হঠাৎ খেয়াল করল মায়ের হাত থেকে একটি জবা ফুল খসে পড়ল কিরনের মাথায়। কিরন খুব খুশি হলো। সে নিশ্চিত হলো তার জীবনে নিশ্চয়ই কেউ আসছে। এবং খুব শিঘ্রই আসছে। কারন কালি মায়ের আশির্বাদ যে সে প্রাপ্ত।
পূজোর তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। এতক্ষনে পূজোর আরতীর সময়ও হয়ে গেছে। কিরন ঠিক করলো সে আজ আরতী দেবে। তাই সে আপন মনে ধূপতী সাজাতে লাগল। কয়েকজন আরতী দেয়া শুরুও করে দিয়েছে। এদিকে ঢাক বাজাচ্ছে পাশের গ্রামের একটি ছেলে। সাদা ফ্রেমের একটা চশমা পড়া। একটি নীল কালো চেকের শার্ট পড়া। সাথে জিন্স। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। কিরন যেন চোখই সরাতে পারছে না। ওর মনে হচ্ছে যেন কোনও স্বর্গের দেবতা মর্ত্যে এসে ঢাক বাজাচ্ছেন। কিন্তু নামটা এখনও অজানা। এতে কিরনের আরও বেশী করে আরতী দিতে ইচ্ছে করছে।
এতক্ষনে কিরনের ধুনুচি সাজানো শেষ। সে শুরু করলো নৃত্য। ঢাকের তালে তালে ধুনুচিচি হাতে সে নাচতে লাগল। প্রায় দেড় ঘন্টা পর একসময় হঠাৎ করে কিরনের হাত থেকে ধূপতীটা পড়ে গেল। কিরনও পড়ে যাচ্ছে ঠিক এই সময় কেউ একজন বলে উঠল সূর্য ওকে ধর। কিরন তো পড়ে যাচ্ছে। পড়ে যেতে যেতে কিরন বুঝল আসলে ঢাকির নাম সূর্য। সূর্য দৌড়ে কিরনের কোমড়টা ধরে ফেলল। কিন্তু দৌড়ে আসার পর নিজের ভার সামলাতেই কষ্ট। তার উপর তো আরেকজনের ভার। তাই কিরনসহ সূর্য মাটিতে পড়ে গেল।
সবাই হাসতে লাগল। কিন্তু সূর্য বা কিরন কারো সেদিকে খেয়াল নেই। তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল একে অন্যের দিকে। অনেক্ষন এভাবে তাকিয়ে রইল তারা। যেন চোখে চোখেই তাদের ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে। মন্ডপী এসে জিজ্ঞাসা করলো কিরে তোদের লাগেনি তো? কিন্তু তাদের ধ্যান ভাঙ্গল না।
মন্ডপী নাড়া দিয়ে বলল কিরে তোরা অমন করে কি দেখছিস একে অন্যের দিকে? কোনো হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকাও তো অমনভাবে চেয়ে থাকে না।
এতক্ষণে তাদের হুঁশ হলো। দুজনেই লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।
-হাই! আমি সূর্য। বলে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
-হ্যালো! আমি কিরন। কিরনও হাতটা বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল।
- বাহ্ ভালোই তো, আপনার নাম সূর্য আর আমি কিরন। অর্থাৎ সূর্যের কিরণ, সূর্যকিরণ। কোথায় থাকেন আপনি?
-এইতো পাশের গ্রামে। আপনি?
-আমার বাড়ী এই পাশেই।
এভাবেই সেদিন পরিচয় হলো দুজনার। সেদিনকার মতো যে যার বাড়ী চলে গেল।
এদিকে অনিমা দেবীর রান্না-বান্না শেষ। সকাল প্রায় নয়টা বাজে। এখনও ছেলেটা ঘুম থেকে উঠল না। তার মা তাকেকে ডাকছে
-কিরে কিরন ওঠ বাবা। নয়টা বেজে গেছে তো। দেখ কে এসেছে।
-কে মা?
-নিজে চোখটা খুলে দেখ না বাবা।
চোখ খুলে কিরন তাকালো।
-একি আপনি?
কিরনের চোখ যেন কপালে ওঠার যোগার।
-আরে সূর্যবাবু আপনি? এতো সকালে? কি মনে করে?
আরে দাড়াও দাড়াও একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর আগে দেব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
তোমরা গল্প করো আমি তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসছি। বলে অনিমা দেবী রান্না ঘরে চলে গেলেন।
২.
-তারপর বলুন কেমন আছেন?
-ভালো। বসতেও বলবে না?
-সরি সূর্য বাবু ভুল হয়ে গেছে। বসুন বসুন।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই। এতো দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে হবে? আরো তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তো। তা তুমি কিসে পড়?
-আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। আপনি?
-আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ার।
এমন সময় অনিমা দেবী চা নিয়ে হাজির হলেন।
চা দিয়ে অনিমা দেবী সূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন আজ প্রথমবার আমাদের বাড়ীতে এসেছো। দুপুরে না খাইয়ে কিন্তু ছাড়ছি না।
-হা হা হা আচ্ছা আন্টি সে দেখা যাবেক্ষন।
আচ্ছা তোমারা থাকো বাবা, চা খেতে খেতে গল্প করো। আমি একটু আসি। বলে চলে গেলেন অনিমা দেবী।
-তোমার বাবা কি করেন কিরন?
এই প্রশ্নে কিরনের চোখ জলে ভিজে গেল। সূর্যের আর বুঝতে বাকি রইল না। তার বাবা ধরনীর মায়া ত্যাগ করে বছর দুয়েক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন দূরে কোথাও।
-আরে এত বড় ছেলে কাঁদে কেন? আমি তো আছি নাকি।
-আপনি? হাসালেন ভাই। আপনি কদিনইবা থাকবেন আমার পাশে? আমি যে অনাথ। বড় একা আমি।
-সূর্য কিরনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল তুমি চাইলে সারা জীবন তোমার পাশে থাকতে রাজি আমি। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি কিরন।
-কি বলছেন এসব আপনি? আর একদিনের পরিচয়ে কি আর ভালোবাসা হয়?
-তুমি চাইলেই হয় কিরন।
বলেই সূর্য আপন বাহুডোরে বেঁধে নিল কিরনকে। আমি তোমাকে নিয়ে সারা জীববন থাকতে চাই কিরন। সুখে-দুঃখে, জীবনে-মরনে একে অন্যের ছায়া হয়ে থাকতে চাই বাবু।
-আমিও যে আপনাকে প্রথম দেখাতেই জীবনের একটা অংশ ভেবে নিয়েছি। আজ আমি বড্ড সুখী সূর্যবাবু।
-হয়েছে হয়েছে এবার আপনি থেকে তুমিতে আসো তো বাপু। আর সূর্যবাবু থেকে শুধু সূর্য। বলে সূর্য কিরকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু এঁকে দিল।
-কি করছেন? দরজা খোলা। মা যেকোনো সময় এসে পড়তে পারেন।
-আবার আপনি?
-ওহ্ সরি! যাও দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।
সূর্য দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় ফিরে আসলো। গালে কিস করলো, ঠোঁটে কিস করলো। ডান হাতটা মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বা হাতটা ক্রমশ নীচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিরনও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সূর্যকে। দুজনেরই শ্বাস ঘন থেকে আরও ঘনতর হয়ে উঠছে। একে একে সব বস্ত্র খুলে ফেলল দুজনে। মেতে উঠল আদিম মানবীয় খেলায়। এ যেন প্রেম নামক রাশলীলে। যেন যা যার সমস্ত শক্তি প্রয়োগেনর প্রচেষ্টা। বহুক্ষণ চলল এভাবে শারীরিক যুদ্ধ। এক পর্যায় যে যার মতো নেতিয়ে পড়ল বিছানার গায়ে।
-কিরে এই অসময় দরজা বন্ধ করলি কেন?
-কি হবে এবার? মা এসে পড়েছেন যে। মা আমি একটু কাপড় চেঞ্জ করছি।
আচ্ছা,,,,,,
তারপর তারা দুপুরে খেয়ে বিকালে বের হলো একটু ঘুরতে। নদীর পারে, গ্রামের কাঁচা রাস্তায় অনেক্ষন ঘুরলো তারা।
এভাবেই একে অন্যের হাত ধরে কেটে গেল বারোটি মাস। কিরন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠল। এদিকে সূর্যের পড়াশুনা শেষ। তাকে এখন যেতে হবে ব্যাংকক। তার মামার কাছে। সূর্যের যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার প্রাণের মানুষ কিরনকে ছেড়ে। কিন্তু আমরা সব সময় যা চাই তা পাই না। মাঝে মাঝে তার উল্টোটাও হয়। আমাদের ভাগ্য যে নিয়তির হাতে বাঁধা। সূর্যের না বোধক কথা শুনে সূর্যের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তাকে যেতে এক রকম বাধ্যই করা হলো। সূর্য কিরনকে এসে সব জানালো।
কিরন কিছু বললো না। শুধু স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। কি করেই বা বলবে সে কথা? তার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। এইতো কদিন আগেও সে একাই ছিলো। অনাথই বলা যায় এক রকম। সূর্য এসে তার জীবনে নিভে যাওয়া প্রদীপটা আবার জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পেয়েছিল সেটা আনন্দাশ্রম। হঠাৎ যেন একটা দমকা হাওয়া এসে দপ করে নিভিয়ে দিচ্ছে তার সুখ প্রদীপটা। ভরা পূর্ণিমার জোৎস্না ভরা চাঁদটা যেন নিমেষেই ঘোর অন্ধকার কালো অমাবশ্যায় ছেয়ে যাচ্ছে তার জীবন নামের আকাশটা। কিরন এক দৌড়ে বাড়ীর ভেতরে চলে গেল। নিজের দরজায় খিল দিয়ে রয়েছে সে ঘরের ভিতর।
অনিমা দেবী এবং সূর্য বাইরে থেকে শত ডাকাডাকি করলো সেদিন কিন্তু দরজা খুললো না। অবশেষে ধাক্কাধাক্কির চোটে দরজা আপন হতেই খুলে গেল।
-এই বোকা বন্ধু বিদেশ যাচ্ছে এতো আনন্দের কথা। তাতে এত কাঁদার কি আছে?
-তুমি একটু বুঝাও তো বাবা। বলে অনিমা দেবী চলে গেলেন। রাত হয়ে গেছে।
-দেখি দেখি আমার বাবুটার মুখখানা একটু দেখি তো। বাবু আমি সারা জীবনের জন্য তো যাচ্ছি না। আমি তো দু'এক বছর পরেই ফিরে আসবো। তারপর তোমাকেও নিয়ে যাবো আমার সাথে। তুমি হাসি মুখে বিদায় না দিলে আমি যাই কি করে বলো তো বাবু?
সেদিন সূর্য কিরনের বাসায়ই থেকে গেল।
অবশেষে ঘনিয়ে এলো সেই দিন। সূর্য যাত্রা করল ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। সেদিনও ছিলো কালি পূজো। কিরন সেদিনও দ্বীপ জ্বেলেছে। হাসি মুখে বিদায় দিল সূর্যকে। কিন্তু সেদিন ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কিরনের ভেতর। বিদায়ের সময় মুখে হাসি ঠিকই ছিলো কিন্তু চোখ কিছুতেই বাঁধ মানছে না। অঝোড় ধারায় ঝড়েছিল সেদিন অশ্রু। হাতে একটা প্রদীপ নিয়ে ঠাঁয় দাড়িয়ে ছিলো কিরন। সূর্যের যাত্রা পথের দিকে।
৩.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিরন এতোক্ষন ভাবছিলো তাদের সুখ-দুঃখের দিন গুলোর কথা। গ্রামের রাস্তা, বাড়ী ফিরতে সমস্যা হতে পারে। বাড়ী ফিরতে হবে। কিরন ধানসিঁড়ি নদীর তীর থেকে উঠে হাটা দিলো বাড়ীর উদ্দেশ্যে। পথে দেখা হলো মায়ের সাথে। অনিমা দেবী খঁজতে বেড়িয়েছেন ছেলেকে। দুপুর হতেই কিরন ঘরে ছিলো না। ছেলেটা যে অসুস্থ। মাকে নিয়ে ঘরে ফিরল কিরন।
-আয় বাবা খেয়ে নে।
-না মা আমার খিদা নেই। খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খাও।
অনিমা দেবী বেশী জোড় করলেন না। আজ বারো বছর ধরেই তো ছেলেটা খাওয়া - দাওয়া ঠিক মতো করছে না। এই একদিনে কি আর এমন ক্ষতি হবে? এমনিতেও তো ছেলেটা বেশীদিন বাঁচবে না। করুক না যা মন চায়।
কিরন অনেক শুকিয়ে গেছে এখন। টানাটানা চোখগুলো যেন গর্তে ঢুকে গেছে। কিরনের হাসিতে এখন আর সেই লাবন্য নেই। বাঁকা হাসিটা ঠোঁটের কোনে এখন আর দেখা যায় না। অনেকেই হয়তো চিনতে পারবে না এখন। আচ্ছা সূর্য কি চিনতে পারবে তাকে? পারবে হয়তো। সে যে ভালোবাসার মানুষ। কিরনের অর্ধাঙ্গ বলা যায়। কিরন আজ আর সেই কিরন নেই। কিরনের এখন ব্রেইন ক্যান্সার। ডাক্তার সব আশা ছেড়ে দিয়ে সবাইকে মন শক্ত রাখতে বলেছে। যে কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। হঠাৎ কিরন চিৎকার দিয়ে উঠল মা বলে। অনিমা দেবীর হাত থেকে বাতিটা পড়ে গেল। দৌড়ে গেল ছেলের ঘরে। কি হয়েছে বাবা? খুব কষ্ট হচ্ছে? কিরন দু হাত দিয়ে কান চেপে ধরে আছে।
-মা মাথায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে মা।
ওষুধ খা বাবা। অনিমা দেবী ওষুধ খাইয়ে দিল। কিরন শুয়ে পড়ল বিছানায়। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সারা রাত মা ঘুমায়নি। জেগে ছিল ছেলের পাশে।
কেটে গেল সেদিন। পরের দিন কালি পূজোর আয়োজন করছে সবাই। কিরনও সবাইকে সাহায্য করছে। সারাদিন কেটে গেল এভাবেই। কিরন আজ খুব খুশি। কারন তার মনের মানুষ আসবে যে কাল। আজ পেট পুরে বহুদিন পর ভাতও খেল কিরন। মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে অনেক গল্প করলো আজ। সবই সূর্যকে ঘিরে। মাও মন দিয়ে শুনছে সব। আর ছেলের অগোচরে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। কিরন ঠিক করলো কাল সে আবার আরতী দেবে। কালই যে তাদের ভালোবাসার তের বছর পূর্ণ হবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মা গেল সন্ধ্যাবাতি জ্বালতে। অমাবশ্যায় কালিপূজো হয়। চারিদিকে অন্ধকার ঘুটঘুটে কালো রাত। কিরন এলো তার ঘরে, বইয়ের পাতার ভিতর দিয়ে একটা ছবি বের করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। সে অনুভব করে এটাই তার সূর্য। মা এলো। দু মা - পোয় মিলে রাতের খাবার খেল। আজ ছেলেকে খুশি দেখে মা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে ঘুমোতে গেল। কিরনও শুয়ে পড়ল।
ঠিক তখনই শুরু হলো আবার যন্ত্রনা। অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলো কিরনের মাথায়। কিন্ত আজ আর কিরন কাউকে ডাকল না। ছবিটা আখড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল চিরতরে।
সকাল প্রায় দশটা বাজে। অথচ আজ কিরন ঘুম থেকে ওঠেনি। কেন? মায়ের মনে শঙ্কা জাগে। গত বারো বছরে তো কিরন এমন করেনি। সে রোজ সকাল ছয়টায় উঠে পড়ে। তার প্রাণ পাখি সূর্য যে তাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে বলেছিল। তাই কিরন রোজ সকালেই ঘুম থেকে উঠত। আজ তো কালি পূজো। কিরনের আজ আরও তাড়াতাড়ি ওঠার কথা। মায়ের মন হঠাৎ ছ্যাত করে ওঠে। মায়ের মাথার ওপর দিয়ে একটি কাক খুব জোড়ে জোড়ে কা কা করতে করতে উড়ে গেল। মা দৌড়ে গেল কিরনের ঘরের দিকে। শাড়ীর পাড়ে পা আটকিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মা। তবুও তার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মায়ের। আসলে মায়েরা এমনই হয়। পৃথিবীর সব মায়ের মনই যে এরকম। তবুও সে আবার উঠে ছেলের ঘরের দিকে যায়। কিরন কিরন বলে ডাকে। কিন্তু কিরনের কোনো সারা শব্দ নেই। মা ছেলের নাকে হাত দিয়ে দেখে ছেলে শ্বাস করছে না। অনিমা দেবী চিৎকার দিয়ে ওঠে কিরন কিরন বলে। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। চিৎকার শুনে বাড়ীর সবাই এসে পড়ে। সবাই কিরনের গুন গাইতে থাকে। আসলে এমনটাই হয়। মানুষ মারা গেলেই তার সুনাম বের হয়। অনেক বোঝায় সবাই অনিমা দেবীকে। কিন্তু মায়ের মন তো! কিছুতেই মানে না। সে চিৎকার দিয়ে কাঁদে আর বলে বাবা তুই আমাকে একলা করে দিয়ে কোথায় গেলি রে বাবা। পূজোর বাড়ী আনন্দময় না হয়ে, হয়ে গেছে বিষাদময়।
৪.
আম গাছ কাটা শেষ। বাঁশও কাটা শেষ। মা কেঁদে চলেছেন তখনও। কাঁদছেন সব শুভাকাঙ্খীরা। কিরনকে নতুন কাপড় পড়িয়ে তোলা হলো বাঁশের খাটে। কারো মোবাইলে যেন গান বাজছে,,,,,
"হাতির দাঁতের পালঙ্ক তোর রইবে সবই পড়ে,,,
যাবি যেদিন শ্মশান ঘাটে বাঁশের দোলায় চড়ে,,,,,,,,
"
বাঁশের খাটে করে নিয়ে যাচ্ছে কিরনকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। অনেক বাড়ীতেই শঙ্খের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আজ যে কালি পূজো।
সূর্য বাড়ীর কাছাকাছি এসে গেছে। মনটা খারাপ তার। সকাল থেকেই মনটা কেমন অস্থির। বিমান থেকে নেমে কয়েকশ বার ফোন দিয়েছে সে কিরনকে। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরছে না। হয়তো কিরন রাগ করেছে। বা কোনো সারপ্রাইজ দেবে বলে সে এমনটা করছে। সূর্য ভাবছে।
সূর্য দেখছে অনেক বাড়ীতেই দ্বীপ জ্বালছে। সূর্য একটু হাসলো। কারন এই কালি পূজোর দিনেই দেখা হয়েছিল কিরনের সাথে। হঠাৎ একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল সূর্য। কান্নার শব্দ শোনার পর সূর্যের মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। ট্রলিগুলো সেখানেই ফেলে রেখে ছুট দিলো কান্নার শব্দের দিকে। দেখছে কাকে যেন বাঁশের খাঁটে করে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশান ঘাটের দিকে। পাশে দেখল কিরনের মা এবং তাদের আত্মীয় স্বজন কাঁদছে। সূর্য এগিয়ে গেল কিরনের মায়ের কাছে।
-তুমি এসেছো বাবা? কিরন যে আর নেই।
-নেই মানে? কি সব বলছেন আবোল-তাবোল? কি হয়েছে কিরনের? দেখুন আন্টি আপনি কিছু লুকাবেন না।
-কিরনের মা আর কিছু বলতে পারল না। তার নিরবতাই সব বলে দিচ্ছে।
-আমার কিরনের কিচ্ছু হতে পারে না। আমি হতে দেব না। আপনারা কাকে নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার কিরনকে? নামন! নামন বলছি। এএএই কিরন কি হয়েছে বাবু? এই এই দেখ আমি এসেছি। তোমার সূর্য। তোমার সূর্য তোমাকে এক মূহুর্তের জন্যও ভোলেনি। দেখো বাবু আমি তোমার জন্য কতো কি এনেছি। কি হলো চোখ খুলছো না কেন তুমি? এতো অভিমান? আমি না হয় ক'দিনের জন্য বাইরেই গেছিলাম। কিন্তু রোজ ফোন করে তোমার খবর তো নিয়েছি বলো। কি হলো চোখটা তো খুলবে? কিরন..........
আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি হচ্ছে কিরনের নাম। মনে হয় সেই ডাক ত্রিলোক পেয়ে গেছে। কিন্তু সে ডাক কিরনের কান পর্যন্তু পৌঁছালো না। কিরনের নিথর দেহটা পাথর হয়ে গেছে।
-কেন করলে এটা তুমি? কি দোষ ছিলো আমার? তুমি এটা করতে পারলে? আমাকে একটা করে দিতে পারো না তুমি কিরন। তোমার কোনও অধিকার নেই। জীবনে মরনে একসাথে থাকার পণ করেছিলাম আমরা। কেন ভুলে গেছো সেটা?
সূর্যের এ হেন আর্তনাতে সবাই অবাক হচ্ছে। হয়তো অনেকে ছ্যা ছ্যাও করছে। কিন্তু আজ আর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না সূর্যের।
সূর্য খেয়াল করলো হাতে কিছু একটা আছে কিরনের। হাত থেকে নিয়ে দেখলো নিজের ছবি এবং একটি চিরকুট। এতো কিছুর মাঝেও এটা হাতেই ছিলো কিরনের। যেখানে লেখা ছিলো,,,,,,
-আমি জানি সূর্য এই চিরকুট তোমার হাতেই পড়বে। এই দেখো আমি তোমাকে আমার বুকের ভেতর করে নিয়ে যাচ্ছি। সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি তোমার দেয়া এক বুক ভালোবাসা। আমি চলে যাচ্ছি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে বাঁচতে দিলো না। কিন্তু তোমাকে বাঁচতে হবে। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। কারন তোমার মধ্যেই তো আমি বেঁচে থাকবো। বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের ভালোবাসা। ভালো থেকো তুমি। বাঁচিয়ে রাখো তোমার মধ্যে আমাকে। তুমি যেদিন ব্যাংকক গিয়েছিলা আমি সেদিন তোমাকে হাসি মুখে বিদায় দিয়েছিলাম। আজ যে তোমার পরীক্ষা সূর্য। দাও আমাকে হাসি মুখে বিদায় দাও ধরণীর বুক থেকে.........
ইতি
তোমার কিরণ
সূর্য চিৎকার দিয়ে কিরনের বুকে ঢলে পড়ল। যে প্রদীপ শিখা একদিন তোমার জীবনে আমি জ্বেলেছিলাম তা তুমি নিভিয়ে দিয়ে কোন পথে যাত্রা করলা কিরন? আমার জীবন প্রদীপটাও তো নিভে যাবে তুমি বিহনে। তোমার দ্বীপযাত্রা হয়ে গেছে আজ মরনযাত্রা সেটা এখন শ্মশান যাত্রা।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখুন। সমকাম জগতে সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। ওরা পেয়েছিল, কিন্তু তা তাদের ভাগ্যে সইল না। কই ওদের তো কোনো দোষ ছিলো না। দিতে চায়নি কেউ কাউকে ধোকা। তবে কেন ভাগ্য ওদের নিয়ে এই জঘন্য খেলা খেলল? নিয়তি সবই নিয়তি। বিধির বিধান খন্ডায় কোনজন। অকালে ঝড়ে পড়লো একটি নিষ্পাপ ফুলের মতো প্রাণ। অকালে মৃত্যু হলো একটি পবিত্র ভালোবাসার। নিভে গেল কিরনের জীবন প্রদীপটা। এখন হাজার চেষ্টা করলেও আর সেই দ্বীপ জ্বালানো সম্ভব হবে না। আমি গেয়ে উঠি,,,,,,,,,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,,, (২)
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ী ধরতে পারলে মন বেড়ী,,
দিতাম পাখির পায়,,,,,, কেমনে আসে আসে যায়।
খাঁচার ভিতর.................
( শুভম )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন