১২ আগস্ট, ২০১৪

একজন মৌনতা - লেখক :মনতোষ দে

রাত তিনটে। হাতে ঘড়ি নেই ওর। তবুও সে বুঝতে পারে কারন এ সময়টা ব্রিজের উপর বসে থাকা টা তার প্রতিদিনের ব্যাপার। এক্টু ঠান্ডা বাতাস, নিচে নদীর কলকল পানি আর শহরের ব্যস্ত মানুষের ঘুম সব কিছুই তার অনেক ভাল লাগে। কারণ এই জিনিস গুলো কারও একার না... এসব ক্ষেত্রে সবাই এক। কি বড়, কি ছোট, কি ধনী, কি গরিব এই সময় টায় সবার ঘুমই গাঢ়। সে প্রতিদিন এসবই ভাবে, এজন্যি এই সময় টা তার এত্ত প্রিয়। ভাল লাগার মাঝে হঠাত করে কখনো কখনো চোখ থেকে জল পড়ে নদীর পানির সাথে মিশে গিয়ে এক হয়ে যায়। এটাতেও তার ভাল লাগে, এক হয়ে থাকার ভাল লাগা। ওর নাম মৌন। বয়স ১৩। নাম টা ওর নিজেরই দেয়া। বাবা মার দেয়া নামটা সে এখন কাউকে বলেনা। ওর এক ভাই, দুই বোন। ও তৃতীয়। ওর ছোট এক্টা বোন আছে। শহরের বেশ ভাল পরিবারেই ওর জন্ম। কিন্তু স্কুলে সে যায়না। এমন না তার পড়তে ইচ্ছে করেনা। কিন্ত পড়ার ইচ্ছের চেয়ে ছোট্ট মনের আত্মসম্মানবোধ টা বুঝি এক্টু বেশি।আর কালকের পর তো পড়ালেখার আর কোন মূল্য থাকবে না তার জীবনে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মৌন বাবা মার কথা ভাবছে। ছোট্ট বেলায় ওর কত্ত মজা ছিল। ৫ বছর বয়সে বাবা ভাইয়া আর ওকে সাইকেল দিয়েছিল। রোজ সেই সাইকেল বের করে তাদের নিজে শিখাত। মা তো ওর জন্য সবসময় নুডলস রান্না করত, নুডলস ওর অনেক প্রিয়। বড় আপু সবসময় অনেক আদর করত। বেশির ভাগ সময় তো আপুর সাথেই রান্নাবাড়ি খেলত। তখন বাবা মা কত্ত খেয়াল রাখত। ছোট বোন হওয়ার পর ও সেই আদর কমেনি। আর আজ!!! কোথায় সবকিছু!
এখন ও রাত তিন্টার সময় বের হয়ে আসলেও কেউ কিছু বলেনা। সব কিছু কেমন বদলে গেছে। বাবা ওকে শিখাবে কি, বাইরে পর্যন্ত নিয়ে যায়না। ও যেতে চেয়েছিল সেদিন। কিন্তু বাবা হুট করে রেগে গিয়ে বাসার সবাইকে অনেক গালাগালি করে বের হয়ে গেলেন। ওকে কিছু বলেন্নি কিন্তু মৌন জানে রাগটার কারণ তার বাইরে যেতে চাওয়া।
ভাইয়া, আপুর ব্যাবহার ও আলাদা। আজকাল ওদের চোখে একধরণের ভয় আর ঘৃণার মিশ্রন দেখা যায়। বিশেষ করে সেদিনের ড: রিপোর্ট পাওয়ার পর।
মা ও আগের মত নেই। কথা বলে না তেমন। একা একা ঘরে বসে কাদে শুধু। মৌন প্রায় ঈ দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকে। ওর আসল নাম ধরে মায়ের আদুরে ডাক শোনার জন্য। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে। ফিরে আসার সময় ও তাকায় বার বার। হয়তো মা দৌড়ে বের হয়ে জড়িয়ে ধরে বলবে ' আমার সোনা মানিক!!! নুডলস খাবি?'
এখন শুধু ছোট বোন টাই ঠিক আছে। হয়তো সে এখনো বুঝে না।যখন বুঝবে হয়তো ও আর ভাইয়া বলে কোলে আসতে চাইবে না। এক্টা রিপোর্ট পুরো জীবন্টাই পাল্টে দিল মৌনর। আগে স্কুলে বন্ধুরা খেপাত মেয়ে মেয়ে বলে। কিন্তু এখন রিপোর্ট অনুযায়ী সে ছেলেও না মেয়েও না।সবাই হিজড়া বলে। হিজড়া কি জিনিস মৌন বেশি বুঝেনা। শুধু জানে এমন একটা কিছু যাকে সবাই ঘৃণা করে, ভয় করে, এড়িয়ে চলে, পরিচয় করিয়ে দিতে চায়না। রিপোর্ট পাওয়ার পরদিন থেকে আর কোনকিছু ঈ আগেরর মত নেই। ওকে স্কুলে যেতে চাইলে, ভাইয়া বলছিল, ' 'ওটা ছেলে আর মেয়ের combined স্কুল! তোর জন্য না' অনেক অবাক হয়েছিল মৌন।কোনদিন বাহানা করে স্কুল না যেতে চাইলে এই ভাইয়াই ভয়াবহ আকারে কানমলা দিত।
তবে আজ এসবে আর এত অবাক লাগেনা। ও বুঝে গেছে দুনিয়ার কাছে ওর প্রয়োজন সেদিনই শেষ হয়ে গেছে, ওর ছোট্ট সেই পরিবারটা থেকেও। এখন প্রায় বাড়িতে এক্টা লোক আসে। সে মৌন কে নিয়ে যেতে চায় নদীর ওপারে মৌন এর মত হিজড়াদের কাছে। মৌন অবশ্য না বলেনি। একটি বারো বাবা কিংবা মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেনি ও থাকবে কিনা। কারণ ও জানে, এখানে ওর থাকার কোন মানে হয়না। ও এখানে আলাদা। নদীর ওপাড়ে গিয়ে যদি কারো সাথে এক হয় তাহলে হয়তো ভাল লাগবে। আর বাবা মাও কিছু বলেনি, তাদেরো হয়তো ভাল লাগবে। একবার চোখ তুলে শুধু জিজ্ঞেস করেছে, ও যখন মরে যাবে তখন সে বাসায় আসতে পারবে? লোক্টা বলেছে, না হিজড়া রা নাকি যেখানে থাকে সেখানেই লবণ দিয়ে দাফন করতে হয় তাতে পাপ মুছে পরের জন্মে পুরো ছেলে বা মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক শক্ত হয়ে যাওয়ার পরো কথাটা শুনে মৌন কান্না থামাতে পারেনি। দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট বোনকে কোলে নিয়ে কেঁদেছে। কাল সে চলে যাবে। কি করতে হবে ওখানে সে জানেনা।এরপর হয়তো ওর লাশটাও আসবে না ওর নিজের বাড়িতে।
ভোর হওয়া শুরু করেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার ব্যস্ত হওয়া শুরু হবে শহর। শেষ বারের মত সবাই কে দেখতে ইচ্ছে করছে মৌনর"
-- অসংখ্য ভাজযুক্ত এক্টা কাগজে লিখাটা আজ সকালে কে যেন আমাদের বাসার পোস্টবক্সে রেখে গেছে।হয়তো বাবার পত্রিকায় ছাপানোর জন্য। লিখাটা দৌড়ে বাবার কাছে নিয়ে গেলাম। বাবা পেপার পড়ছে। - বাবা দেখ। এক্টা অনেক সুন্দর লেখা কে যেন দিয়েছে। বাবা প্লিজ এ লেখাটা ছাপিও - ওহ মামনি। অনেকেই ভাল লিখা দেয়। দাড়াও এক্টা খবর পড়ছি - না বাবা লেখাটা অন্যরকম। তুমি পড়েই দেখ। উফ! কি পড়ছ মন দিয়ে? দেখনা। - আজ আমাদের ব্রিজের নিচে ১৩ বছরের এক বাচ্চার লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ ভাবছে আত্মহত্যা। এতটুকুন পিচ্চির কি সাহস রে বাবা! দেশ যে কোথায় যাচ্ছে!!
বুক্টা ধ্বক করে ঊঠল আমার। মৌন নয় তো?? নিজেরর বাসায় দাফন হওয়ার জন্য ও এটা করল না তো? আর থামাতে পারছিনা নিজেকে।
- কি ব্যাপার মা? কাদছ কেন? আরে!!! কি হল?????? - বাবা, আমি ছেলে হলে ভাল হত? - ধুর পাগলি!! আমার কাছে ছেলে মেয়ে সমান। দুইটা ঈ তো আমার সন্তান! -আর হিজড়া হলে???? বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?