১২ আগস্ট, ২০১৪

অদেখা বাঁধন - লেখক : মনতোষ দে

ঋজুর সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে। তিন বছর আগের ঘটনা। শেষের কবিতা পড়ে তখন ঋজুর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি এবং একজন ঋজুর খোঁজে পাগলের মত ফেসবুক চষে বেড়াচ্ছি। ফেসবুকে ঋজুদের অভাব নেই। ঋজু নামে সার্চ দিতেই প্রায় কয়েকশো ঋজু এল। এরমধ্যে কেউ কেউ বালুরঘাট কলেজ থেকে পাশ করেছে । এরকম আরও কতো শত .........।। কিছু কিছু ফেক আইডি ও রয়েছে ...... আমি মোটামুটি আশাহত হলাম এত ঋজুর খোঁজ এক সাথে পেয়ে ...। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সুবিধা হত। তাঁর কাছ থেকে একদিনের জন্য ঋজুকে ধার চাইতাম।
কথায় আছে কোন কিছু মনে প্রানে চাইলে ভগবান তা মানুষকে মিলিয়ে দেয়। আমি ঋজুকে পেলাম। তবে কোন লাবন্য নাম ধারী আইডিতে না। খুব সাধারন একটি আইডিতে। জল জোছনা। জলের ওপর জোছনার অপূর্ব প্রতিফলন আমি অনেকবার দেখেছি। তবে জল জোছনা নামটি সম্পূর্নই আমাকে পাল্টে দিল। দিন কিংবা তারিখ মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে মন খারাপ করা একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। আমি তখনো জানতাম না একটি স্ট্যাটাস ই আমার জীবনে ঋজুকে এনে দেবে। স্ট্যাটাসটি ছিল ছুটি শেষে কলেজে ফিরে যাওয়া বিষয়ক। দেখলাম কিছুক্ষন পর ইনবক্সে একটি মেসেজ। চার লাইনের একটি কবিতা সাথে কয়েকটি লাইন। কবিতাটি ছিল,
"প্রিয় কেউ যদি কষ্ট দেয় মনের সংগোপনে আকাশ ভাঙা কান্না তাই আসে চোখের কোনেদুঃখ ভরা সেই প্রহরে আমায় করো মনেদোলা দেব হাসি হয়ে তোমার অধর কোনে"
''কবিতাটি তোমার দেয়া স্ট্যাটাস থেকে নেয়া। আমি কবিতা লিখতে পারিনা। তাই তোমার কবিতা দিয়ে তোমাকেই শান্ত্বনা দিলাম। তোমার মন ভালো হয়ে যাক। ছুটি শেষে আবার ফিরে এসো। ঋজু"
ঋজু নামটা দেখে বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হল। আমি খুব সুন্দর একটি রিপ্লাই দিলাম। এরপর থেকে চ্যাটিং। একটা পর্যায়ে ঋজু ওর জীবনের অনেক কিছুই শেয়ার করলো। আমাদের মোবাইলে কথা হল। জানতে পারলাম ঋজু আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। কোলকাতায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ঋজুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। আমার বড় কেউ ছিলনা। ঋজু যেদিন থেকে এই নির্মম সত্যটি জানলো সেদিন থেকেই আমার জীবনের এই অপূর্নতাটা পূরন করতে উঠে পড়ে লাগলো। ভাবতে অবাক লাগত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ব্যস্ত তাঁর গতানুগতিক জীবন,পড়ালেখার চাপ, ল্যাব, বন্ধু আড্ডা আর হাজার কাজের ভীড়েও আমাকে স্মরন করছে। ফোন করে কথা বলছে। উপদেশ দিচ্ছে।
আমাদের কলেজ হোস্টেল এক অদ্ভুত শাসনের অন্তভূক্ত হওয়ায় প্রতিটি চিঠিই সেন্সর করা হতো। অর্থাত্ প্রথমে তা বড় দাদারা পড়তেন এবং পরে আমাদের কাছে দিতেন। বাবা মা ছাড়া অন্যকারো চিঠি অ্যলাউ ছিলনা। তবুও অনেক কষ্টে সেই নিয়ম কানুন এর ফাঁকেও ঋজু চিঠি পাঠাতো। আমি প্রতিদিন হাউসবেয়ারার কাছে ওর চিঠির খোঁজ নিতাম। ঋজু, কোলকাতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই লাইনটি চিঠির ওপর দেখলে আমার অবরুদ্ধ মন তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত। আমাদের ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেই তখন প্রেম করছে। প্রতিদিন তাদের নতুন নতুন প্রেম আর ছ্যাঁকা খাওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প শুনি।
মাঝেমাঝে ঈর্ষান্বিত হই ক্যানো আমার গার্লফ্রেন্ঠ নেই এই ভেবে।এর মাঝে ঋজুর পাঠানো একটি চিঠিই আমার অশান্ত মনকে শান্ত করতো। মনে হতো পৃথিবীতে অন্তত কেউ একজন আছে যে এই আধুনিক যুগেও আমাকে ভেবে লেখে। আমার জন্যে লেখে। উল্লেখ আমাদের কলেজে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। তাই এত আয়োজন। হঠাত করে অনুভব করলাম পৃথিবীতে প্রেম কিংবা ভালোবাসার বাইরেও এক নিবিড় ও পবিত্র সম্পর্ক সম্ভব। যা আমার আর ঋজুর মধ্যে ছিল।চিঠির মাধ্যমেই আমাদের সম্পর্ক আরো গাঢ় হল। একটা পর্যায়ে চিঠির সাথে কার্ড আসা শুরু হল। ভেতরে অপরিপক্ক হাতের কিছু নকশা। আমি বুঝলাম এতসব আয়োজন,আঁকিবুঁকি সবই আমাকে খুশী করার জন্য। কিছুদিন পর কলেজে মোবাইল ফোন নিলাম। এক প্রকার টীচার দের চোখ এড়িয়ে। ততদিনে বেশ সিনিয়র ও হয়ে গেছি। ঋজুর সাথে কথা হত দুপুরে। লাঞ্চ এর পর। স্যারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য খাঁটের তলা বেছে নিতাম কথা বলার নিরাপদ জায়গা হিসেবে। ঋজু নিজেই ফোন করতো । এক ঘেঁয়েমির ক্লান্ত সময়ে যেন এক চিলতে প্রশান্তি। আমাদের সময় গুলো ছিল অস্বাভাবিক সুন্দর। মুঠোফোনের বেতার তরঙ্গে সম্পূর্ন অদেখা এক অদ্ভুত সম্পর্কের ভীত গড়ে উঠছে। কখনো কখনো ছোট ভাইয়ের মত ওর কাছে ভীরু আব্দার আবার কখনো ও শাষনকর্তা। গতিময় জীবনের ফাঁকে স্থবিরতা আনার সুযোগ ও কখনো দেয়নি। আর তাই তুমুল বর্ষা কিংবা অপূর্ব জোছনার মায়াবী রাত সব সময়ের সঙ্গী ছিল ও। ওর মনখারাপের মুহূর্ত কিংবা প্রবল উচ্ছাসে কাটানো কলেজের পিকনিক সব কিছুই ভাগ করে নিত নিদ্বির্ধায়।
ওর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বহুবার ও আমার জন্যে অনেক কিছু পাঠিয়েছে। ওর দাবী ছিল একটাই কোলকাতায় গিয়ে ওর সাথে দেখা করা। একটা পর্যায়ে কলেজ থেকে বের হয়ে ইউনিভারসিটি লাইফে পদার্পন করলাম। তবুও সম্পর্ক থাকলো আগের মতই। সেই আগের মতই ফোন দেয়া। খোঁজ খবর নেয়া। তবে চিঠি দেয়াটা একটু কমে গেছে। জীবনের হিসেবে আমার ও সময় হয়ে ওঠেনি ওর সাথে দেখা করার। সুদীর্ঘ তিন বছরের বিন্দু বিন্দু আবেগ অনুভূতি তখন সিন্ধুর রূপ নিয়েছে।
এমনি এক ছুটির সকালে ঋজুর ফোন এলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয়েছিল যখন শুনলাম ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে।
কোলকাতা থেকে সরাসরি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্দেশ্য এই অভাগাকে দেখা। আমি বিশাল বড় একটা সারপ্রাইজ পেলাম। মনে হল ক্ষুদ্র জীবনে বেঁচে থাকার অনেক মানে আছে। বিশাল এ পৃথিবীর কাছে আমরা ক্ষুদ্র হলেও কারো কারো কাছে আমরা পৃথিবীর মত বিশাল। সৃষ্টিকর্তা এক অদেখা বাঁধন তৈরি করেছেন আমাদের মাঝে। যা জটিল এবং ভয়াবহ রকমের সুন্দর।অবশেষে ঋজু আমার সামনে এলো। শেষের কবিতার ঋজু। যতটুকু আমার কল্পনায় ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি স্নিগ্ধ। প্রিয় মানুষ গুলোর পাশে থাকার মুহূর্তগুলো যে অদ্ভুত সুন্দর তা টের পেলাম ওর উপস্থিতিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত পরিবেশ থেমে থেমে অশান্ত হচ্ছে ওর আর আমার পাগলামীতে। দেখে কে বলবে এ আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। প্রিয় মানুষগুলোর পাশে থাকার মুহূর্ত আসলেই অদ্ভুত সুন্দর। চেনা আবেগ চেনা হাত ধরা আর সবশেষে চির চেনা সেই বিদায়।
ঋজু আমার হাত ধরে কেঁদেই ফেলল।মনে হচ্ছিল গল্পের শেষ কোনদৃশ্যে এসে আটকে গেছি। ইচ্ছে করলেই ঋজুর চলে যাওয়াটাকে ফেরাতে পারবো। কিন্তুবাস্তবতা গল্পের মত নয়। তবে সুন্দর একটি ছেলেকে চোখেরসামনে কাঁদতে দেখে মনে হল বাস্তবতা গল্পের চেয়েওসুন্দর। মনে মনে তখন একটি গানই বাজছিল,
"যদি শেষ দেখায় এ হাত ধরে
ঐ চোখ জলে ভরেযদি বাঁচতে ইচ্ছে হয় আরো কিছুক্ষন
তবে রেখোনা অভিমানমনে অকারন
মমতা যদি বা গড়ে ওঠেযদি চেনা টানে মন ছোটে
তবে দাও গেঁথে এ বেলায় অদেখা বাঁধন/পিছু ফেরার এ আয়োজনে করোনা বারন
এনেছি তোমার অনেক শখের সেইমিষ্টি উপহার
আঙুলের ছোট ছোট আদরে নাওনা শেষবার
কাজলের দীঘি ছুঁয়েই বুঝিএত মায়ার কারন
বুঝলোনা শুধু এই অবাক ভুবন
দুটি হৃদয়ের সেই কথোপকথন. . . . . . . .
নির্বাক পৃথিবী আসলেই সবাক হৃদয়ের কথোপকথন বোঝেনা।...............।।
যখন-ই স্বপ্ন দেখা শুরু করি তখন-ই স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে যায় এক অদূশ্য ঝড়ে, সুখ গুলো উড়ে যায় হাওয়ায়, হেরে যাই আমি স্বপ্নের কাছে, হেরে যাই বার বার জীবনের কাছে. স্বপ্ন আর বাস্তব এক নয় এই কথা ভুলে ও আসেনা মনে, শুধু স্বপ্ন দেখেই গেলাম জীবন ভর, বাস্তবতা খুজে পাইনি আজ ও। কত শত প্রিয় জন কত প্রতিস্রুতি দিয়ে আশায় বুক বাধাঁলো ।কত স্বপ্ন দেখালো দু চোখ ভরে, আজ জীবনের ক্লান্তি কালে চলে গেল সবাই নিজ গন্তব্যে ।শুধু পড়ে আছি আমি পথ ভুলা পথিকের মতো ,আজ স্বপ্ন গুলো আর বাসা বাধেঁনা চোখের পাতায়, দুঃখে কষ্টে বুকের পাজর গুলো ক্ষত বিক্ষত, হৃদয়ের প্রতিটি স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্তনায় আমাকে প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।স্বপ্নের পিছু ঘুরতে ঘুরতে আজ বড়-ই ক্লান্ত আমি।
উৎসর্গ : প্রিয় জল জোছনা অথবা শেষের কবিতার ঋজু.......

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?