২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

লাইফ উইদাউট লাভ - ১৮

কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে ...

লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে মিয়া ভাই এবং দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত নাড়ছেন। একটু একটু করে লঞ্চ বানিয়াখালী লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। লঞ্চের যান্ত্রিক চিৎকারে বিকেলের বাতাস ভারী হয়ে গেলো। আকাশের দিকে ছুটে গেলো একরাশ কালো ধোঁয়া। ঘাটে দাঁড়িয়ে রহিম আমি দুজনেরি হাত নাড়ছি। রহিম মর্জিনার সাবান দিয়ে কেচে দেয়া শার্ট পরে এসেছে। মুখে উপচে পড়া হাসি। আমার হাত খানাই নড়ছে শুধু। মুখে কি বিষাদের ছায়া নাকি কালো ধোঁয়ার আভা ! বুকটা আমার ছিড়ে যাচ্ছে। আমার মুখের হাসিটুকু কি চলে যাচ্ছে এই লঞ্চে করে ?

কয়েকদিনের ব্যস্ত সময়ে আমি ভুলেই গেছিলাম অনেক কিছু। পড়ালেখা মাথায় উঠেছে। মায়ের বকুনি শুনে সন্ধ্যার একটু পরে পড়তে বসেছি। কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে। রহিম আমার ঘরের ওপাশের চৌকি খাঁটে ঘুমায়। সে দোকানে গেছে কেরোসিন তেল কিনতে। এখনো বিদ্যুত আসে নাই এদিকে। কয়রা থানা সদরে অবশ্য বিদ্যুত আছে। আমি প্রথম বিজলি বাতির আলো দেখি কয়রা থানা সদরে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। এখনো মধ্য যুগের মত কেরোসিনের কুপি বাতিই আমাদের ভরসা। কেরোসিনের প্রদ্বীপকে আমরা বলি টেমি।

দরজায় ঠুকঠুক শব্দ শুনে আমি ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। মিয়া ভাই ফিরে আসার পর আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। মিয়া ভাই যেন মুল ভিলেন। সারাক্ষণ বন্ধুর পাশে কেন থাকতে হবে! কিন্তু আমার ঘরে কে নক করে আসবে ! সবাই এসে দড়াম করে দরজা খোলে। ছোট হওয়ার এই এক জ্বালা । প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকে না।
আমি বললাম, কে ?
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, আমি দ্বীপ্ত।
- ভেতরে আসছেন না কেন ভাইয়া?
আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি এরই মধ্যে দ্বীপ্ত ভাইয়া রুমে ঢুকে ভেজানো দরজা আবার ভিজিয়ে দিয়ে দরজার কপাটে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ালেন। নি:শব্দে আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার চোখের চাহনি আমাকে বাঁধনহারা করে ফেললো। আমি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের তৃষ্ণার্ত অধরে প্রেমের সুধাবারি বর্ষিত হতে লাগলো ।

দ্বীপ্ত ভাইয়া যে আমাকে ভেতরে ভেতরে এতটা মিস করেছে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাহিরে তিনি ছিলেন সহজ সরল প্রাঞ্জল। দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখের মনি কাঁপছে।
- কি হয়েছে জান ?
- আগামীকাল আমি চলে যাচ্ছি।

আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া যে বেড়াতে এসেছে, দুদিন বাদে চলে যাবে এই কথাই তো আমি ভুলে গেছিলাম।
- এত দ্রুত যাবে কেন ? আমি যেতে দিলে তো !
- আজ না হোক কাল যেতেই হবে। তাছাড়া সজলই তাড়াহুড়া করছে।

আমি আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না। দুচোখ কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে এলো। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার বুকে মাথা রাখলাম। শব্দ করে কাঁদতে পারছি না। চাঁপা কান্নার উচ্ছ্বাসে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি। আমি মাথায় কয়েক ফোঁটা গরম জল পড়লো। আমি মুখ তুলে দেখি দ্বীপ্ত ভাইয়াও কাঁদছেন নিরবে। তার হাতের আঙুলগুলো আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমিও দিলাম। তার ঠোট নেমে এলো আমার ঠোঁটে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের আগে হয়তো এটাই আমাদের শেষ চুমু।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেটে সেই আকাশ নীল শার্ট। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললো, তুমি আমাকে কি দেবে? কি দেবো ! আমি দেওয়ার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। ঘরের চারদিকে তাকাই। কি দিবো আমি !
- শুভ্র, তুমি আমাকে আমার জীবনের সেরা কিছু মুহুর্ত দিয়েছ। আমার খুব ইচ্ছে করে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেই । পুব বিলের মাঝে, শালিক খালির নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি স্মৃতি হিসেবে তোমার ব্যবহার করা এই গামছাটা নিয়ে যাবো। দেবে আমাকে ?

- তুমি আমাকে সাথে নাও। আমি ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবো । আর শুধু গামছা কেন, আমার সব কিছুই তোমার্। সব কিছু নাও তুমি।
পাগল ছেলে একটা। বলে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রহিমের গলার স্বর শুনে হাত সরিয়ে নিলেন।

- খবর শুনিছো ছোড ভাই। ম্যাভাই কাইলকে চলে যাবে। আমাগে তো আগোয় দিতি যাতি হবে। তাড়াতাড়ি করে খায়ে শুয়ে পত্তি হবে।

- তুই আছিস তোর শোয়া নিয়ে। যাবে তো বিকেলের লঞ্চে। তাতে তোর এখনি ঘুমানো লাগবে !

রহিম বকা খেয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার সময় দরজা হাট করে খুলে রেখে গেছে। খোলা দরজায় মিয়াভাইয়ের মুখ দেখা গেলো।

- শুভ্র, পড়াশোনা করছিস তো। দ্বীপ্ত কাছ থেকে অংক দেখিয়ে নিলে পারতি। অংকে দ্বীপ্ত সবসময় ৯৫% করে মার্ক পেয়ে এসেছে। গার্জেনদের এই এক সমস্যা। বাড়িতে লেখাপড়া জানা কেউ এলে বলে অমুকের কাছ থেকে ইংরেজি অংক দেখে নে।

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?