২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

লাইফ উইদাউট লাভ - ১৯

বিকেল পাঁচটার লঞ্চ ঘাটে এলো সাড়ে পাঁচটার কিছু পরে। পশ্চিম আকাশে তখন সুর্য্য হেলে পড়েছে। দিগন্ত জুড়ে লাল আবিরের ছড়াছড়ি। ঘাটে এসে গেছি সাড়ে চারটার দিকে। আমরা পুরুষ বিশ্রামাগারে বসেছি। আমি বসেছি দ্বীপ্ত ভাইয়ার গা ঘেঁসে। চেনা গন্ধটাকে বুক ভরে নেয়ার চেষ্টা করছি।মিয়া ভাইয়ের সুটকেস রহিম মাথায় করে নিয়ে এসেছে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ব্যাকপ্যাক টা আমার কাঁধে চড়ে এলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া নিজেই বয়ে আনবে । আমাকে তো কিছুতেই নিতে দেবে না। আমি জোর করেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম।

মিয়া ভাই রহিমকে সাথে নিয়ে আগে আগে অনেক দুর এগিয়ে হাটছিলেন। আমি আর দ্বীপ্ত ভাইয়া পাশাপাশি হাঁটছি। মনের ভিতর হাজার কথা আকুপাকু করছে। কিন্তু মুখের কথা হয়ে সেগুলো বের হচ্ছে না। আজ দ্বীপ্ত ভাই সাবলীলভাবে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে এলো। অথচ প্রথমদিন সাঁকো পার হওয়ার সময় সেকি কাঁপাকাঁপি। তার কাঁপুনিতে পুরো বাঁশের সাঁকো দুলতে শুরু করলো। সে বাঁশের দুদিকে পা ঝুলিয়ে মাঝ সাঁকোয় বসে পড়লো। দোকানঘরের সামনে কয়েকজন লোক বসা ছিলো। তারা হেসে উঠলো শহুরে বাবুর কান্ডকারখানা দেখে। তার করুন অবস্থা দেখে আমারো হাসি পেয়েছিলো। শেষে আমি তার হাত ধরে ওপারে নিয়ে যাই। মাফলারে মুখ ঢাকা ছিলো বলে তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু তার ফর্সা সুন্দর হাত দেখি এবং ধরার পর থেকে এক অন্যরকম মুগ্ধতা শুরু হয়।

সাঁকোর কিছু আগে নতুন দাদির বাড়ি। নতুন দাদি বাড়ির মাটির প্রাচীরের গায়ে গোবরের ঘুটি লাগাচ্ছিলো শুকানোর জন্য। এই অবেলায় গোবর চটকাচ্ছে। কাজ ছাড়া নতুন দাদীকে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। এই ক্ষ্যাতের বেড়া বাঁধছে নয়তো নাতনীর হাত ধরে ছাগল গুলোকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষন সে গরুর জাবর কাটার মত পান চিবায়। নতুন দাদা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে নতুন দাদিকে খুব খেঁপাতো। নতুন দাদি খুব হাসিখুশী একজন মানুষ ছিলো। কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার পর অনেকটা মৌন হয়ে গেছে। আগের মত হাসির কোন কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খায় না, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে গাঁয়ে হলুদে কাঁদামাটি করে না। গানে গলা মেলায় না। উঠতি মেয়েদের নাঁচে হারিয়ে দিতে চায় না। নতুন দাদির ছেলেটা গঞ্জের দোকান থেকে ভালোই আয় রোজগার করে।

নতুন দাদি আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। পানের রসে তার ঠোট টুকটুকে লাল হয়ে আছে। পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন, শহরের কুটুম বাড়ি যায়? -

- হ্যাঁ।
- আমাগে বাড়ি বসো।
- না, আজ থাক।  দেরী হয়ে যাবে।

আমরা এগিয়ে যাই। নতুন দাদি তার নাতনীকে ডাকতে থাকে। নাতনীর নাম রেখেছে তার মামারা শাকিলা আক্তার্। নতুন দাদি ডাকে তারাচান বানু বলে। মেয়ের নামের বিকৃতি নিয়ে পুত্রবধু কয়েকদিন কথা বলার চেষ্টা করেনি এমন নয়। কিন্তু নতুন দাদি কান দেয় নাই। নাতনি এসে নতুন দাদির আঁচলের খুঁটে বাঁধা পান সুপারি তার মুখে তুলে দেয়। নিজেও এক টুকরা গো ( সুপারি) মুখে পুরে ছোট দাঁত দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে।

বাড়ি থেকে বেরোনোর পর রাস্তায় দেখা হয় গফুর গাছির সাথে। সে গুড় নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। দ্বীপ্ত ভাইয়া তার দিকে হাত বাড়ালো। গফুর গাছি নিজের তেল চিটচিটে গামছায় হাত ঘষে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলো। হ্যান্ডশেকের আরবি মোসাফাহ। গফুর গাছি দ্বীপ্ত ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ঢাহায় খাঁজুরের গুড়ের দর নাকি অনেক বেশি? শুনিছি সেহানে সের প্রতি পুঞ্চাশ ষাইট টাকা কইরে দর পাওয়া যায়। রাস্তা ঘাট সিরাম চিনা জানা নাই । জানা থাকলি একবার দুই কলসি গুড় বেঁচে আসতাম।

গাছির সরলতায় অন্য সময়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া নিশ্চিত হাহা করে উঠত। আজ ঠোঁটে হালকা হাসি ফুঁটিয়ে বললো, গফুর ভাই। ঢাকা শহর এখান থেকে অনেক দুর্। দুই কলস গুড়ের দামে তোমার আসা যাওয়ার খরচে লেগে যাবে। যদি কিছু মনে না করো তবে এটা রাখো।

দ্বীপ্ত ভাইয়া বেড়াতে আসার আগে অনেক কিছুই নতুন করে কিনে এনেছিলো। যদিও সেগুলো ব্যবহার করার দরকার হয় নাই। তার নতুন কেনা তোয়ালে টা বাড়িয়ে দিয়েছেন গফুর গাছিকে। গফুরের চোখে খুশির চকচকে ভাব।

- না । কিছু মনে করবো ক্যান। আল্লার নবী গাঁয়ের বস্তর খুলে গরীব দুখীকে দিয়ে দেতো।

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা আর ফুফু বরাবরের মত কান্নাকাটি করলো। আব্বা দেখে শুনে ভালোভাবে যেতে বললেন। মিয়া ভাই সবাইকে কদম বুচি করলেন। তাকে দেখে দ্বীপ্ত ভাইয়াও কদম বুচি করলেন।

মা বললেন, থাক বাবা । সালাম করতে হবে না। দোয়া করি। অনেক বড় হও। আমাদের এখানে তো কয়েকদিন তোমার থাকা খাওয়ার অনেক সমস্যা হলো। আবার বেড়াতে আইসো।

মা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। গ্রামীন টানে তিনি বেশ শুদ্ধ বাংলা বলেন মাঝে মাঝে। যদিও তাতে সাধু ভাষার শব্দের প্রাবল্য থাকে।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, কষ্টের কথা কি বলছেন চাচীমা। আমি আমার জীবনের সেরা সময়টা উপভোগ করলাম এই কয়দিনে। আমার তো ইচ্ছে করছে সারা জীবনের জন্য এই গ্রামে থেকে যেতে।
মিয়া ভাই বন্ধুকে ফোঁড়ন কেটে বললো, মা দেখতো গ্রামে বিবাহ যোগ্যা কোন মেয়ে আছে কিনা। বিয়ে দিয়ে দ্বীপ্ত মিয়াকে ঘর জামাই হিসেবে রেখে যাই।
সবাই হেসে উঠলো। মিয়া ভাই দ্বীপ্ত ভাইয়াকে তাড়া দিলো, নে এবার বের হ। আসার সময় এমন ভাব নিলি যেন মনে হচ্ছিলো সুন্দরবনের মাঝখানে যাচ্ছিস। এটা সেটা কত কি কিনলি। তোর ব্যাগ থেকে মশারি বের হলেও আমি অবাক হতাম না।

দ্বীপ্ত ভাইয়ার আনা অনেক জিনিসের মধ্যে আছে মা ও ফুফুর জন্য ঢাকার জামদামি শাড়ি। সবাই বেড়াতে এসে প্রথমেই উপহার বের করে। আর দ্বীপ্ত ভাইয়া বের করলো যাওয়ার দিন সকালে। সবাই চমক পেলো। সেই শাড়ী এখন পরা মা ও ফুফুর পরনে। রহিমকে দিলো বডি স্প্রে । সেই বডি স্প্রে রহিম এখন এতটা মেখেছে যে সারা বাড়ি সুগন্ধময় হয়ে গেছে। মা ফুফু আমাদের এগিয়ে দিতে রাস্তা পর্যন্ত এলেন। যতক্ষন আমাদের দেখা যায় ততক্ষন তারা দাঁড়িয়ে রইলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?