২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

লাইফ উইদাউট লাভ - ১৭

চলনা ঘুরে আসি অজানাতে , যেখানে নদী এসে থেমে গেছে...

ভটভট করে ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। বানিয়াখালি ফরেস্ট ক্যাম্প পেরিয়ে এসেছি একটু আগে। নদীর ডানপারে সুন্দরবন, বামপাশে লোকালয়। নদীর বুকে ঘোলা পানি। নদীর পাড়ের মেয়ে বধুরা নেটের জাল নিয়ে কোমর পানিতে টানা দিচ্ছে চিংড়ীর পোনা ধরতে। একজায়গায় দেখছি বুড়ো বুড়ি ছোট্ট নৌকায় বসে কাঁকড়া ধরছে। মাঝে মধ্যে সুন্দরবনে জীবিকার অন্বেষনে যাওয়া বাওয়াল , মৌয়াল, জেলেদের ফিরে আসা নৌকা দেখা যাচ্ছে। তারা জোরে জোরে বৈঠা বাইছে। খুলনা গামী একটা দোতলা লঞ্চ আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। পানির ঢেউয়ে ট্রলার খানা দুলে উঠলো।

ট্রলারে আমরা গুটিকয়েক মানুষ। হাল ধরে বসে আছে ছাকা মাঝি। ছাকার নাম ছাকিম। কিন্তু গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এটা ছাকা হয়ে গেছে, যেমন আজিজুল হয়ে যায় আইজুল, বাকের হয় বাকা। ছাকার বাপ রমজান মাঝি খেয়াঘাটে মানুষ পারাপার করত। শক্ত সামর্থ্য লোকটা গত অগ্রহায়নে হঠাৎ করে মারা গেলো। ছাকা কিছু টাকা জমিয়ে ট্রলার খানা বানিয়েছে কয়েক মাস আগে। ভাড়ায় মহাজনদের মাল টানে এই হাট থেকে ওই হাটে। মিয়া ভাইয়ের বয়সী। ভাইয়া ট্রলার খুঁজছে শুনে সে নিজে এসে বললো, জালাল ভাই আমার টলার থাকতি ভাড়া কত্তি যাবা ক্যান। আমিই কাইলকে তুমাগে নিয়ে যাবো বাঁদা দেখাতি। ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে সে কিছুতে রাজি হলো না।

একবার ওদের পুবের বিলের দুই বিঘে জমি নিয়ে সরদার বাড়ির মজিবর সরদারের ঝামেলা হয়। মজিবর সরদার ভুয়া কাগজ বানিয়ে গরীবের শেষ সম্বল জমিটুকু গাপ করে দেয়ার ফন্দি আঁটে। ছাকার বাপ গরীব ঘাটের মাঝি। অফিস আদালত কোট কাচারি করবে কিভাবে। আব্বা হাট থেকে সদাই নিয়ে একা ফিরছিলো। মাঝি বৈঠা টানে কিন্তু নৌকা এগোয় না। আব্বা মাঝিকে শুধায়, শরীর খারাপ? মাঝি মাথা নাড়ায়। শরীর খারাপ না। মনডা বড় ব্যাজার্। বাপ দাদার শেষ সম্বল দুবিঘে জমি, তাও ধরে রাখতে পারছে না। পোলাডার জন্য কিছুই রাইখা যাইতে পারবে না সে। সারাদিনে খেয়া পারের টাকায় সংসারই চলে না। মামলা মোকদ্দমা চালাবে কি দিয়ে। আব্বা রমজান মাঝিকে শুধু টাকা দিয়ে সাহায্য করেনি উপরন্তু নিয়মিত কোর্টে যেত মাঝির সাথে। এটা নিয়ে সর্দার বাড়ির লোকের সাথে আমাদের ঝামেলা হয়। বিল থেকে একদিন আমাদের একটা খাসি ছাগল নেই হয়ে গেলো।

ট্রলারের ছাদে বসেছে দ্বীপ্ত ভাইয়া, মিয়া ভাই ও মিয়া ভাইয়ের স্কুলের বন্ধু রবি ভাই, খোকন ভাই, গোলাপ ভাই। রবি ভাই স্কুলে পড়া শেষ করেনি বখাটে পনা স্বভাবের কারণে। তার বাপ তাকে বিয়ে দিয়ে গঞ্জের হাটে নিজেদের দোকানে বসিয়ে দিয়েছে। রবি ভাইয়ের ছেলেই এখন প্রাইমারিতে পড়ে। খোকন ভাইয়া কলেজ পর্যন্ত পড়েছে। দুইবার পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেন নি। উদাস কবি টাইপের মানুষ। গানের গলা আছে। বাউল গানে আসর মাতাতে তার জুড়ি আমাদের গ্রামে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই গানের সুত্র ধরেই পাশের গ্রামে অখিল সাহার বাড়িতে তার নিয়মিত যাতায়াত । অখিল সাহার মেয়ে কবিতা রানী সাহার সাথে খোকন ভাইয়ের প্রেমের গল্প গ্রামে চাউর আছে। মেজ দাদি বলে, গ্রামে কি মোচলমানের মাইয়ার আকাল পড়ছে যে মালাউনের মাইয়ার লগে সাদি করতে হবে। গোলাপ ভাই পড়াশোনা করছে। খুলনা বিএল কলেজে পড়ে বাংলা সাহিত্যে।

দ্বীপ্ত ভাইয়া তাদের সাথে মিলে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সেই রাতের পর থেকে আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু সময় এত দ্রুত কেটে যাচ্ছে যে কিছুই টের পাই না। আজ ট্রলারে আমি তার গা ঘেঁষে বসলাম। দেখলাম তিনি চুপচাপ। সরে এলাম। ট্রলারের গলুইয়ে বসেছি আমি এবং রহিম । ট্রলার এখন মুল নদী ছেড়ে শাখা নদী দিয়ে বেশ ভেতরে চলে এসেছে। দুপাশেই সুন্দরবন। গাছের সারি দেখলে মনে হয় কোন মালির হাতে সযতনে লাগানো গাছের বাগান। গেওয়া, গরান, ধুন্দল, পশুর, বাইন, সুন্দরী, কেওড়া গাছের সারি। কোথাও গোলপাতা বন। গোলপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে বাঘ।

আব্বা পইপই করে বলে দিছে যেন সুন্দরবনের বেশী গভীরে না যাই। বাঘের ভয়ে নয়। ডাকাতের ভয়ে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ডাকাতের উৎপাত অনেক বেশী। সুন্দরবন হচ্ছে ডাকাতদের অভয়ারন্য।

সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য হচ্ছে বিশুদ্ধ এবং নির্মল। এই অপরূপ রূপের বর্ননা ভাষায় বর্ননা করা সম্ভব নয়। শুধু দুচোখ ভরে উপভোগ করা যায়। বনের মাঝে শুনশান প্রশান্তিময় পরিবেশ। ভটভট শব্দে ট্রলার এগিয়ে চলে। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ। সাদা বকের দল তার নিচ দিয়ে উড়ে গেলো। গাছের ডালে বসা মদন টাকটি ঝিমুচ্ছে। তার পাশের ডালে উড়ে এসে বসলো একটি বন মুরগী।মদনটাক একটু মাথা উচু করে দেখে আবার ঘুমিয়ে গেলো। বনমুরগী টি কোকর কো করে ডাকতে লাগলো। নিচের থেকে বনমোরগের পাল্টা ডাক শোনা গেলো। কিন্তু দেখতে পেলাম না। মুরগিটা সেদিকেই উড়ে গেলো। বনমুরগী উড়তে পারে । এরা কক মুরগীর মত স্লিম হয়।

রহিমের ডাকে ফিরলাম। নদীর পানির উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে সাঁতরে পার হচ্ছে কি একটা সাপ। রহিম বললো, দেবো নাকি বাশের লগি দিয়ে একটা বাড়ি!

আজব হাতে লাঠি থাকলেই বাড়ি মারতে হবে! খোকন ভাই ভাটিয়ালি সুর ভাসিয়ে দিলো বাতাসে, কে যায়রে ভাটির গাঙ বাইয়া, আমার ভাইজানরে কইয়ো ....

গান শেষ হলো বান্দরের চেঁচামেচিতে। কেওড়া গাছের ডালে ঝুলে বুড়ো ধেড়ে কচি জোয়ান বাঁদরের দল চিৎকার করছে। খুব সম্ভবত তাদের মধ্যে কোন কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ছাঁকা ভাই মিয়া ভাইকে জিগাইলো সামনে যাবে কিনা ?
সামনে একটু রিস্ক আছে। দুইদিন আগে কোহিনুর ডাকাতের দল দুই জেলেকে তুলে নিয়ে গেছে জোড়া খালের মাথা থেকে। বিশ হাজার টাকা মুক্তিপন চাইছে মহাজনের কাছে। মিয়া ভাই ট্রলার ঘোরানোর নির্দেশ দিলেন।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, এত দ্রুত ফিরে যাবো? মিয়াভাই: গাছপালা আর কত দেখবি! দ্বীপ্ত: বাঘ হরিন কুমির কিছুই তো দেখলাম না।
খোকন ভাই : বাঘ কুমিরকে চিঠি না দিয়ে এলে কি তারা দেখা করে।
ট্রলার ফেরার পথ ধরেছে। গোলপাতা বন পার হবার আগেই একটা হরিন শাবক কে দেখা গেলো। আমরা সব হইহই করে উঠলাম। বাচ্চাটা থমকে দাঁড়ালো। তার মা ছুটে এলো। তারপর সে মায়ের সাথে দৌড়ে পালিয়ে গেলো বনের ভেতর। হরিন দেখার আনন্দ আমাদের চোখে মুখে। কিছু মানুষের উপস্থিতি, কিছু প্রানী আমাদের মনে অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়। বাড়ি ফিরে আসতে আমাদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। দুপুরে বাড়িতে খাবার কথা ছিলো। মা রান্না করে বসে আছেন পথ চেয়ে।

ফুফু বলেন , বাঁদায় গেলি তা একটা হরিন ধরে আনলি না ক্যান। পুষতাম।
সবাই মিলে খেতে বসলাম। পারছে মাছ ভাজা, ভেটকি মাছ ভুনা, বাগদা চিংড়ির কোর্মা। বড় বড় বাগদা মাছ কিনে এনেছে আব্বা। দ্বীপ্ত ভাইয়ার পাতে ফুফু বেশ কয়েকটা তুলে দিলো। আমি চিংড়ি খেতে পারিনা। গা ঘিন ঘিন করে। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার প্লেটে একটা তুলে দিলো। সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। সবাই দেখতে চাচ্ছে এবার আমি কি করি।

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?