২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

অতঃপর...তাহারা দুজন

রাত ১১ টা বাজে ।
বেড সাইড টেবিলে রাখা একটা কেক ।
তাতে ছোট একটা মোমবাতি গুঁজে জ্বালাতে জ্বালাতে ভাবছি ...
“অয়ন, আর এক মিনিট পরেই তোর বয়স এক বছর বেড়ে যাবে” ।
সময় খুব অদ্ভুত ।
কখন যে জীবনের ৩২ টা বছর পেরিয়ে গেছি, টের পাইনি ।
আজ আমার জন্মদিন ।
৩৩ এর কোঠায় পা রাখতে যাচ্ছি আজ ।
নিজেকে বেশ বুড়ো বুড়ো লাগছে ।
একা একাই বার্থ ডে সেলিব্রেট করছি ।
কিছুটা কষ্ট নিয়ে চোখ বুজতেই অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল ।
মনের ভেতর চেনা অচেনা অনেক মানুষের ভিড় ।
কিছু কিছু স্মৃতি গুলো এতো তাজা মনে হচ্ছিল ! যেন গতকাল আমার সাথে ঘটেছে ।
আচমকা একটা শব্দে চমকে উঠলাম ।
ফোন বাজছে ।
ফোন এর রিং টোনের উপর আমার একরকম এলারজি আছে ।
শান্তিতে কাজ করতে দেয় না এই রিং টোন ।
কানে নিয়ে হ্যালো বলার সাথে সাথেই ছোট ভাই এর মা বাবা উইশ করলো।
আমি অবাক হলাম না ।
স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললাম ওদের সাথে ।
আমি শুধুই হুম হুম করে যাচ্ছি ।
কিছুখন কথা বলে ফোন রেখে দিলাম ।
এর পর পরই কিছু ক্লাসমেট রা ফোন দিল ।
কেউ কেউ মেসেজ দিল ।

ঘড়িতে কখন যে ১২ টা ৫০ বাজে । খেয়াল করিনি ।
এখন আর উইশ করার মত কেউ নেই ।
বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলাম ।
আবারও অনেক কথা এক এক করে মনে পড়ছে ।
স্মৃতিরা মাঝে মাঝে কথা বলে উঠে ।
কিন্তু খুব নিঃশব্দে কথা বলে ।
চোখ বুজে মনে হচ্ছিল আমি একজন আবছা ছায়া মানব কে দেখতে পাচ্ছি ।
কেমন যেন অস্পষ্ট ।
নাহ ।
কিছুতেই তার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না ।
এমন সময় ফোনটা আবার বেজে উঠল ।
উফ ।
রিং টোন সাইলেন্ট করতে কেন যে আমার মনে থাকে না !

-হ্যালো ।
ফোনের ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠল
-ভালো আছেন ?
-জি ভালো । কে বলছেন প্লিজ ।
-চিনতে পারছেন না ?
(গলাটা খুব চেনা চেনা লাগছিল , কিন্তু খুব একটা মনে করতে পারছিলাম না )
-আসলে না । কে বলছেন সেটা যদি একটু বলতেন । ভালো হত ।
-অয়ন সাহেব । আপনি তো দেখি আমায় ভুলে গেলেন !
-আসলে আজকাল তেমন কিছু মাথায় থাকে না । প্লিজ ভাই নামটা বলুন । না বললে আমি ফোনটা রাখব । বেশ ঘুম পাচ্ছে আমার !
-আচ্ছা শুনুন, Happy birthday & many many happy returns of the day.
এবার আমি একটু অবাক হলাম ।
-থ্যাংকস । আপনি কে বলুন তো ? আমার নামটাই বা জানেন কি করে ? আর আজ যে আমার জন্মদিন সেটা কেমন করে জানেন ?
-আপনি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না ?
-আসলে গলাটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কার গলা ঠিক মনে আসছে না ।
-হা হা হা । আমি দীপ্ত । চিনতে পেরেছেন এখন ?
-দীপ্ত ! দীপ্ত ! ( চোখ বন্ধ করে বললাম), কিছু মনে করবেন না প্লিজ, কোন দীপ্ত ?
-হা হা হা । এই বয়সেই এই অবস্থা ! ৫০ বছর হলে কি করবেন ?
-তাতে কি ! দরকার হলে দেয়ালে একটা ট্যাগ বোর্ড লাগিয়ে রাখব । ওতেই কাজ হবে ( একটু ভারি গলায় বললাম )
-ভালোই বলেছেন ! হা হা হা ।
-আপনি কিন্তু বললেন না । আপনি কোন দীপ্ত ?
-তা কয়টা দীপ্ত কে চেনেন আপনি ?
-জি । অনেককেই চিনি । আপনি কোনটা বলুন ?
-আচ্ছা । শুনুন । আমি আপনার খুব কাছের বন্ধু ছিলাম । আরও ছিলাম ভার্সিটির বন্ধু ।
-তা মশাই কি কবিতা লেখেন ? মনে হল ছন্দ মেলানোর চেষ্টা করছেন ! হা হা হা ।
-এবারো চিনতে পারেন নি ?
-উম্মম্মম্মম্মম্মম্মম্মম না ।
-তাহলে থাক । আজ আর আপনার ঘুম নষ্ট করব না । ভালো থাকবেন । শুভ রাত্রি ।
-ওকে । আপনিও ভালো থাকবেন । গুড নাইট ।

ফোনটা রেখেই চোখ বুজলাম ।
কে এই দীপ্ত ?
আমার ভালো বন্ধু !
কে ইনি ?
হথাত করে স্মৃতির সেই ছায়া মানব আমার চোখের পাতায় হাজির ।
দীপ্ত ! দীপ্ত............
এতো বছর পর !
সেই ৬ বছর আগে ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ।
এতো বছর ধরে তাকে এতো মনে করেছি ।
এতো অনুভব করেছি ।
আর আজ যখন সে আমায় ফোন দিল তখন তাকে চিনতে পারলাম না !
তাড়াহুড়া করে ফোনটা হাতে নিলাম ।
ডায়াল করলাম দীপ্তর নম্বরটা ।
একবার ডায়াল হল ।
কোন সাড়া নেই ।
২য় বার ডায়াল করলাম ।
কোন সাড়া নেই ।
এবার একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম ।
আর ফোন করা ঠিক হবে না ।
তবুও শেষবারের মত ট্রাই করলাম ।
এবার সাথে সাথেই দীপ্ত ফোনটা রিসিভ করল ।

-হ্যালো ।
-হাই দীপ্ত !
-হুম ।
- আ...আমি আমি অয়ন ।
-জানি তো । তা মনে পড়েছে আমায় ?
প্রচণ্ড খুশি হলাম আমি ।
এতো খুশি যে রিতিমত আমার পেট ব্যথা করছিল ।
ছোট থেকেই আমার এটা হয় ।
বেশি টেনশন বা খুশি হলে আমার বুক কাঁপে আর পেট ব্যথা করে ।






-হুম । মনে পড়েছে ।
-হা হা হা । তা কেমন আছ ?
-এই তো কাটছে দিনগুলো কোনোভাবে ।
-কেন ? এমন কেন ? অয়ন । অনেক কিছুই বলার আছে তোমাকে । কিন্তু ফোনে সম্ভব না । তুমি এখন কোথায় থাক ?
-আমি ধান মণ্ডিতে । তুমি ?
-আমি গুলশানে । কাল মানে আজ বিকেলে তোমার কি সময় হবে ? দেখা করতাম । দীপ্ত জিজ্ঞেস করল ।
-ওকে । কিন্তু কয়টায় ?
-তুমি না ধানমণ্ডি লেক এর সামনেই এস । ওখানেই না হয় দেখা করব ।
-ঠিক আছে তাহলে ৫ টার দিকে চলে এস ।
-ওকে আমি থাকব । বাই ।
-বাই । গুড নাইট ।
ফোনটা দীপ্ত কাটল ।
খুব এক্সসাইটেড হয়ে গেলাম আমি ।
দীপ্তর সাথে ৬ বছর পর আবার দেখা হবে ।
ভাবতেই পারছিনা !
চোখ আবারও বন্ধ করলাম ।
এবার আমি শুধু তাকে দেখছি ।
তার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ।
চোখ ভিজে যাচ্ছে ।
জলে ।
এই জল আনন্দের নাকি কষ্টের ! বুঝতে পারছি না ।
মাঝে মাঝে মানুষের কান্না আটকানোর সাধ্য থাকে না ।
আমারও এখন তাই হচ্ছে ।

আচ্ছা ! দীপ্ত কি সেই আগের মতই আছে !
ইস ।
সেই হাসি । সেই রাগ । সেই চেহারা !
সময় যেন কাটছে না আমার ।
আজ রাতে আর ঘুম আসবে না ।
সেটা বুঝতে পারছি ।
কেন জানি এখন আর কেকের বুকে ছুরি চালাতে ইচ্ছা করছে না ।
মোম বাতি টা তুলে কেকটা ফ্রিজে রেখে দিলাম ।
বেডরুমে এসে ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি !
টের পাই নি ।

ভোর ৫ টায় এলারম বেজে উঠল ।
জগিং করতে বের হলাম ।
আজকের ভোর টা খুব ভালো লাগছিল ।
কেমন যেন অন্যরকম একটা ভোর ।
চারপাশ এতো স্নিগ্ধ । এতো ঝকঝকে ।
বাসায় ফিরে শাওয়ার নিলাম ।
নাস্তা সেরেই ছুট দিলাম অফিসে ।
রাস্তায় যা জ্যাম !
অফিসে পৌঁছতেই সবাই উইশ করতে লাগল ।
বেশ ভালো লাগছিল ।
নিজের ডেস্কে বসতেই দীপ্ত ফোন দিল ।
-গুড মর্নিং অয়ন ।
-হুম । গুড মর্নিং ।
-কোথায় ? অফিসে নাকি ?
-হা ।তুমি ?
-আমি মাত্র যাচ্ছি । রাস্তায় ।
-ওহ ।
-মনে আছে তো ? সময়মত চলে এস কিন্তু !
-কিন্তু তুমিত সঠিক টাইম টা বল নি । তুমি বলেছ ৫ টার দিকে !
-হা হা হা । অভ্যাস পাল্টাও নি দেখছি ।
-যে অভ্যাস বদলে যায় সেটা কি কোন অভ্যাস হল নাকি ?
-হুম । তাইতো ! এখনও এভাবে কথা বল তুমি ?
-ওই যে বললাম অভ্যাস ।
-আচ্ছা । বিকেল ৫ টায় চলে আসবা ।
-ওকে । এখন রাখি । টেবিলে ফাইল জমে আছে কয়েকটা ।
-ওকে । বাই ।
-বাই ।

ফোনের কথা শেষ হয়ে গেছে ।
কিন্তু কথার রেশ যেন ফুরোচ্ছে না ।
কানে এখনও বাজছে......বিকেল ৫ টায় চলে এসো কিন্তু...বিকেল ৫ টায় চলে এসো কিন্তু...
দীপ্ত আর আমি দুজন একসাথে ইঞ্জিনিয়ারিং করেছি একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ।
ও দেখতে ভালোই ছিল ।
অনেকটা রাফ এন্ড টাফ ।
আর আমি ছিলাম মফস্বলের আর ১০ টা সাধারন ছেলের মত ।
ভার্সিটির প্রথম দিন ।
আমি ওর পাশেই বসে আছি ।
আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা আমার ধাতে নেই । তাই পাশে বসেও হাই হ্যালো বলিনি ।
নতুন জায়গা । নতুন পরিবেশ । আমার কোন বন্ধুই নেই এখানে ।
দীপ্তই প্রথম বন্ধুত্তের হাত বাড়াল ।
-হাই । দিস ইজ দীপ্ত ।
আমি হাত বাড়িয়ে নিচু স্বরে বললাম
-অয়ন । আমি অয়ন ।
হথাত ক্লাসে টিচার ঢুকল । তাই আর আর তেমন কথা হল না ।
ক্লাস শেষে দীপ্ত বলল
-চল । ক্যান্টিনে যাই ।
-হুম । চল ।
ক্যান্টিনে বসতেই দীপ্ত কফির অর্ডার দিল ।
-মামা । দুইটা কফি । তা ঢাকায় কোথায় থাক ? নাকি বাইরে থেকে আসছ ?
-আমি রাজশাহী থেকে । তুমি ?
-আমি ঢাকার পাশেই ।
-মানে ?
-আমার বাসা সাভারে । কিন্তু এখন ভার্সিটির জন্য ঢাকায় শিফট হলাম ।
- হুম ।
-আচ্ছা । তুমি কি চশমা পর ?
-হা । কেন ?
-না এমনি । পাওয়ার কত ?
-একটা গোপন কথা বলি , আমার চশমায় পাওয়ার নাই । হা হা হা ।
-তাহলে পরে আছ যে ?
-আসলে চশমা আমার পছন্দের একটা জিনিস ।খুব শখ ছিল চশমা পরব । কিন্তু কখনও চোখের সমস্যা হয় নি । কিন্তু তাই বলে আমার শখ অপূর্ণ রাখব ? সেটা হতে পারবে না । তাই পাওয়ার ছাড়া চশমা কিনে ফেললাম । হা আহ হা । চশমা পরলে নিজেকে বেশ বুদ্ধিমান বুদ্ধিমান লাগে । হা হা হা ।
-ও ভালো । পুরাই শেয়াল পণ্ডিত । হা হা হা ।
মামা টেবিলে কফি দিয়ে গেল ।
খেয়াল করলাম ও এক চুমুকে কফি গিলছে ।
আমি তো অবাক !
কারন আমি গরম কিছুই খেতে পারি না ।
তাই মগ হাতে নিয়ে কফিতে ফু দিচ্ছিলাম ।
দীপ্ত আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এতো ফু দিচ্ছ কেন ?
-না । অনেক গরম তো তাই !
-তাতে কি ? আমি তো গরম খাচ্ছি !
-আমার অভ্যাস নেই । তাই খেতে পারি না ।
- ঠিক আছে । চামচ লাগবে ? হা হা হা ।
-নাহ । প্রবলেম নাই ।

দুজনে কফি শেষ করে সেদিনের মত বিদায় নিলাম ।
এরপর অনেক সময় কেটে গেল ।
কেমন করে যেন একে অন্যের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম ।
বন্ধুই ছিলাম আমরা ।
ওর পাশে থাকতে আমার বেশ ভালো লাগত ।
খুব উপভোগ করতাম ওর সংগ ।
ও অনেক মজা করত ।
একবার সে আমায় বলল
-দোস্ত ! তোর হাসি খুব সুন্দর !
-তাই ! হা হা হা । যাহ্‌ বেটা । এই তেল টা আমারে না দিয়া কোন মাইয়ারে দে গিয়া । খুশিতে তোর প্রেমে পইরা যাইব ।
-না রে দোস্ত । সত্যি বলছি তোর হাসি টা আমার ভালো লাগে ।
-থাক থাক । আর কইস না বাপ । হাসতে হাসতে আমার পেট ফাইটা যাইব । হা হা হা ।

সেদিন আমি অদ্ভুত এক অট্টহাসি হেসেছিলাম ।
এমন মুহূর্ত আমার সামনে এর আগে কখনোই আসে নি ।
আমরা সব সময় জ্বালাতাম । একে অপরকে ।
অবশ্য ওর বরাবরই বেফাঁস কথা বলে ফেলবার একটা বদ অভ্যাস ছিল ।
ইমোশনাল কথার ফাঁকেও মাঝে মাঝে এমন হাসির কথা বলত যে না হেসে উপায় থাকত না ।
এই হল দীপ্ত ।
ভার্সিটিতে যাওয়ার সাথে সাথেই ও আমার কাঁধে লাফ দিয়ে পড়ত ।
ও যেদিন এই কাজটা করত না সেদিন আমিই করতাম ।
ইচ্ছে করে ।
আমাদের দুজনের মাঝে শুধু বন্ধুত্বই ছিল ।
কিন্তু আমি সমপ্রেমি । ওকে ভালো লাগত , ভালও বাসতাম ।
কিন্তু কোনদিন মুখ ফুটে প্রকাশ করিনি ।
পাছে ওর বন্ধুত্ব টুকু হারাই ।
তাই বুকের ভেতর শুধু বন্ধুত্বের অনুভূতি টুকু নিয়েই ওর সাথে থাকতাম । সময় কাটাতাম ।

একদিন দীপ্ত আমায় ডেকে বলল,
_দোস্ত । একটা কথা বলি ?
-বলে ফেল । কানে এখনও ঠোসা লাগে নি । এখনও ভালোই শুনতে পাই আমি ।
-জানিস ? তুই মেয়ে হলে আমি সত্যি সত্যি তোরে নিয়া পলাইতাম !
-কেন ? কেন?.........হুম । তোর লগে পালাইয়া অনাহারে মরি আর কি ! খাওয়াইতিকি ? ঘাস ? হা হা হা ।
-আরে পালাইয়া দেখতিস ! কতকি খাওয়াইতাম !
-একটা ব্যাপার বুঝলাম না ! তোর সাথে পালাতে আমার মেয়ে হওয়া লাগবে কেন ? এখন পালাতে সমস্যাটা কই ? আমি কি লুলা ? যে দৌড়াতে পারুম না ! এখনও আমার দুইটা পা আছে আর মেয়ে হইলেও দুইতাই থাকত । তাই না ? চল পালাই । হাহা হা ।
-ভালোই কইসস । হা হা হা ।

আমি যে ওকে চাই সেটা আমি জানতাম ।
কিন্তু সে কি তা আমি জানতাম না ।
আসলে জানার দরকার মনেই করিনি ।
ও সুদর্শন ছিল ।
তাই প্রচুর মেয়ের সাথে তথাকথিত প্রেমও করেছে অবলীলায় ।
মেয়েদের সাথে Flirt করতে আর মন ভাঙতে ওর নাকি ভালো লাগত ।
ওর এই জিনিসটা আমি মেনে নিতে পারতাম না ।
ভালো লাগত না ।
তাই মাঝে মাঝে ওকে বলতাম

-আচ্ছা । এতো জনের মন ভাঙ্গিস , তোর খারাপ লাগে না ?
-না । এতে খারাপ লাগার কি আছে ?
-যাই বল । কাজটা তোর মোটেই ভালো না ।
-আরে, ওই মেয়েরাও তো ওরকমই ! তুই জানিস না । এক জনকে ওদের বেশিদিন ভালো লাগে না । ৬ মাস পর আমাকে ছেড়ে দেবে । এই সুযোগটা আমি কাউকেই দিই না । তার আগেই সব খেলা ফিনিস !
-কি জানি ? দেখিস এগুলো বেশি করলে কিন্তু ফেঁসে যাবি ।
-আরে নাহ । কিছুই হবে না ।
-ভাই তুইই বুঝিস ওগুলা ।
দেখতে দেখতে অনেক সময় কেটে গেল ।
দিন, মাস, বছর ।
আমার স্মৃতির পাতাগুলোও কমে আসছে ।
আমার স্মৃতি বলতে আমি আর দীপ্ত । আমাদের ক্লাস এক্সাম নোট করা খুনসুটি । এইসব ।

সেবার আমরা সবে সেকেন্ড ইয়ার এর লাস্ট সেমিস্টার এর এক্সাম দিয়েছি ।
আমরা দুজনই আলাদা মেসে ছিলাম ।
আমি অনেকবার একসাথে থাকতে চেয়েছি ।
ওই চায় নি ।
ওর যুক্তি ছিল আমরা এমনিতেই আড্ডাবাজ । সারাক্ষন ফান করি । চিল্লাপাল্লা করি ।
একসাথে থাকলে আর যাই হোক । পড়াশুনা হবে না ।
আমার মেসে সেদিন কেউ নেই ।
পুরাই ফাঁকা ।
ভার্সিটির ছুটি খুব অল্প দিনের ছিল । তাই আমি বাড়ি যাই নি ।
শুয়ে বসে একা একা দিন কাটছে আমার ।
কেমন একটা বিরক্তি ভাবও আসত মনে ।
ভাবলাম দীপ্তকে একটা ফোন করে দিই ।
ফোন রিসিভ করেই ও বলল,
-কিরে কিপটা ! ফোন দিসিস ! মতলব টা কি ?
-কেন রে ? আমি কি তোরে ফোন দিই না ?
-না । ঠিক তানা ! এমনি ! বল কি হইসে ?
-কইরে তুই ?
-মেসে । তুই ?
-আমিও আমার মেসে ।
-কেন ? বাড়ি যাস নি ?
-সেটা তো আমারও প্রশ্ন ! তুই যাসনি ?
-না । কেন জানি ভালো লাগছিল না ।
-ও । চল দুজন মিলে বাইরে থেকে কোথাও বেড়িয়ে আসি ।
-কই যাবি ? এসময় !
-কি হইসে তোর ? এমন শুনাচ্ছে কেন তোকে ?
-কিছু না ।
-আচ্ছা ঠিক আছে । তুই আগে আয় তো !
-ওকে । আসছি ।
এটা বলেই দীপ্ত ফোন রেখে দিল ।
ঠিক মিনিট কুড়ির মাথায় ও আমার রুমে আসল ।
ওকে দেখে আমি তো অবাক.........!

ও একটা রেড টি শার্ট, রেড শু আর ব্ল্যাক জিন্স পরে এসেছে ।
যা হ্যান্ড সাম লাগছে না ওকে !
আমি তো চোখ ফেরাতেই পারছিলাম না ।
আর চুপ করে থাকতে পারলাম না ।
-বাপরে ! ডেশিং লাগছে তোকে !
-সত্যি ভালো লাগছে ?
-আমার কি ঠেকা লাগছে তোকে পাম দেয়ার । যা ভাগ !
-আচ্ছা হইসে । চল এখন ।
আমরা দুজন রওনা দিলাম চন্দ্রিমা উদ্যানের উদ্দেশ্যে ।
জায়গাটা আমার বেশ পছন্দের ।
শুধু ওই ভিড়টা আমার বিরক্ত লাগে ।
আজ যেন আমার চারপাশটা একটু বেশিই সুন্দর লাগছিল ।
আকাশ টা নীলের সাথে হালকা সোনালি রোদ ।
যেন ক্যানভাসের একটা আঁকা ছবি ।
ওর দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছিলাম ।
এমনভাবে ওকে কখনও দেখি নি ।
আজ কেন জানি ও খুব চুপচাপ !
আমরা দুজন হাঁটতে লাগলাম ।
ও তখনও চুপ ।
এবার কিছুটা বিরক্ত হলাম ।
রাগ হল একটু ।
-ওই গাধা, চুপ কেন তুই ?
-নাহ । এমনি ।
-তুই তো চুপ থাকার মানুষ না ! কিছু একটা তো হইসে ! কি সেটা ?
-কিছুনা ।
-বলবি না ? ঠিক আছে , বলিস না । আমার কি !
-আসলে ...।
-আসলে কি ? বল !
-না থাক । বাদ দে ।

ওকে জোর করতে আর ভালো লাগছে না ।
আসার সময় যতটা এক্সসাইটেড ছিলাম যাওয়ার সময় ঠিক ততটাই মন খারাপ ছিল আমার ।
পুরো রাস্তায় মনে হল এটা কি সত্যি দীপ্ত!
নাকি অন্য কেউ ?
বাইরে ডিনার সেরে রাত ৮ টা নাগাদ আমরা আমার মেসের রুমে আসলাম ।
ও চলে যেতে চাইল ।
আমি ওকে থেকে যেতে বললাম ।
ও হ্যাঁ না কিছুই বলল না ।
রুমে ঢুকেই বলল
-লাইট অফ কর ।
-কেন ? ( অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম )
-খুব ঘুম পাচ্ছে । তুই লাইট অফ কর ।
-মানে কি ? এই সময় কি কেউ ঘুমায় ? আমার তো জীবনেও ঘুম আসবে না ।
-তোর কথা তো আমি বলি নি । আমি আমার কথা বলছি । লাইট অফ কর । আমি ঘুমাব ।
-মানে কি ? আচ্ছা কি হইসে তোর ! আমায় বল তো ! কারো সাথে ব্রেক আপ হইসে ?
-আমায় ঘুমাতে দিবি ? নাকি আমি চলে যাব ?
-আচ্ছা আচ্ছা হইসে, আর রাগ দেখানো লাগবে না । তার আগে ফ্রেশ হয়ে আয় ।
-হুম । যাচ্ছি ।

আমি আমার একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ওর হাতে দিলাম ।
ও ফ্রেশ হয়ে এলো । খালি গায়ে ।
এক হাতে ওর প্যান্ট আর এক হাতে ওর টি শার্ট ।
আমার দেয়া প্যান্ট টা এমন ভাবে পরেছে মনে হচ্ছে কোমর গলিয়ে এই বুঝি প্যান্ট খুলে যাবে ।
আমি বিছানা ঠিক করতে করতে আড় চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম ।
হথাত ও আমার দিকে তাকাল ।
আমি চোখ সরিয়ে নিলাম ।
ওই বলল,
-কি দেখছিস এভাবে ?
আমি আমতা আমতা করছি ।
-কই .........কই ! কিছু নাতো !
-আমি দেখলাম তুই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি ।
আবার আমি একটু লজ্জা পেলাম ।
গাধাটা যখন জানতই আমি ওকে দেখছি । তাহলে এভাবে ফলাও করে বলার কি দরকার ছিল !
খালি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে ও ।
আমি একটু লজ্জা নিয়ে চোখ নামিয়ে বললাম,
-হ্যাঁ । দেখছিলাম তো । দ্য গ্রেট দীপ্ত সাহেব কে দেখতে বুঝি টিকিট কাটতে হবে ?
ও মুচকি হেসে বলল,
-কি ? ! ? !
-কিছুনা । তোর বিছানা রেডি । ঘুমা ।
-তুই ঘুমাবিনা ?
-তোর মত এতো আগে ঘুমানোর অভ্যাস আমার নাই । তাই ঘুম আসবে না । তুইই ঘুমা ।
ও আর কথা না বাড়িয়ে ধরাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল ।
সবে রাত ৮ টা ৩০ বাজে !
আর এসময় তো কুম্ভকর্ণও ঘুমায় না ।
আমার রুমে থাকতে ভাল্লাগছে না ।
কানে হেড ফোন গুঁজে ছাদে গেলাম ।
রাতের ঢাকা শহর দেখতে দারুন লাগে ।
চারদিকে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা আরও কত রঙ্গের আলোর ফুলকি !
চারদিকে আলোর খেলা ।
এতো আলোর মাঝে মাথার উপরের চাঁদটার দিকে আমার নজর পড়েনি ।
আজ যেন চাঁদটাকে একটু বেশিই বড় লাগছে ।
কানে রবীন্দ্র সঙ্গীত আর এমন নিস্তব্ধ পরিবেশ । দুটোই বেশ লাগছে আমার ।
চোখ বন্ধ করে শুনছি ।

“ চোখে আমার তৃষ্ণা ।
ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়েরে.........

ইশ ।
কবিগুরু কেমন করে যে এই আবেগগুলো গানে ফুটিয়েছেন !
সত্যি ! বাঙ্গালির আবেগ আর অনুভুতির পূর্ণতা যেন এই রবি ঠাকুরের গানে ।
এতো বছরেও বাঙ্গালির অনুভূতি এক বিন্দু পাল্টায় নি ।
সেই আবেগ , অভিমান, দুঃখ, প্রেম, টানা পোড়েন এগুলো নিয়েই আমরা বাঙালি ।
চোখটা বুজে ছাদের কোনায় দুহাত দুদিকে মেলে দাঁড়িয়ে আছি আমি ।
কি যে ভালো লাগছে আমার !
চোখ বুজে আমি এখন অন্য রাজ্যে ।
এমন সময় ছাদের দরজায় “ঠং.........” করে একটা শব্দ হল ।
আমি ভয় পেলাম একটু ।
বললাম,
-কে ? কে ওখানে ?
বিদঘুটে গলায় কে যেন বলল,
-আমি ।
আমি এবার আরও একটু ভয় পেলাম ।
ছাদে আলো নেই ।
আর ফ্লোরের আলো গুলোও নেভানো ।
আমি ভয়ে ভয়ে আবার বললাম,
-আ...আমি কে ?
কে যেন এবার বলল,
-কি রে শালা ! ডরাইসোস !
অবাক হয়ে বললাম,
-কে দীপ্ত ?
আড়াল থেকে সামনে এসে এবার ও হা হা করে হেসে বলল
-তুই এতো ভিতু ! জানতাম না তো ?
-কে । কে বলছে আমি ভিতু ? আমি মোটেও ভয় পাইনি । আমি জানতাম ওটা তুই ই । ( গলায় এমন একটা ভাব আনলাম যেন আমি একটুও ভয় পাই নি )
-যাই বল । আগে জানলে তোকে আরও ভয় দেখাতাম ।
-হুম । তুই উঠলি কখন ? তুই না ঘুমালি ? তোর নাকি মরনের ঘুমে ধরছে ? গেলো কই সেগুলা ?
-ঘুম আসছে না রে ......।
-এতো আগে কখনও ঘুমাইসিস ? যে ঘুম আসবে !
-হুম ।
দুজনেই আবারও চুপ ।
হথাত আমার মাথায় ২০০ ওয়াটের বাতি জলে উঠল ।
আমি বললাম,
-আচ্ছা ! কখনও ছাদে শুয়ে রাত কাটিয়েছিস ?
-নাতো । কেন ?
-চল । আজ আমরা ছাদে শুই ।
-পাগল নাকি ? সারারাত মশার কামড় খাওয়ার ইচ্ছা আমার নাই ।
-আরে দু খানা কয়েল না হয় লাগিয়েই দিব । আর তাছাড়া ছাদে তো মশা লাগে না ।
এই বলেই দিলাম এক ছুট । রুমে ।
দীপ্তর মতামত জানতেও চাই নি ।
বয়েই গেল !
ওর আবার মতামত !
দুটো বালিশ, এক খানা চাদর আর এক খানা বড় মাদুর নিয়ে এসে ছাদে বিছানা পেতে আমি শুয়ে পড়লাম ।
দীপ্ত অবাক হয়ে আমার কাণ্ড কারখানা দেখছে ।
আমি ওকে বললাম,
-কি রে ? এখন হা করে দাঁড়িয়ে রইলি যে ? শুবি না ? আয় । শুয়ে পড় ।
ও চুপচাপ হুলো বেড়ালের মত আমার পাশে শুয়ে পড়ল ।
এবার আকাশের চাঁদ টা ছিল ঠিক আমাদের মাথার উপর ।
মাথায় এই মুহূর্তে একটা গান বাজছে

“ওগো চাঁদ তুমি কি জানো না
সে যে নাম ধরে ডাকবে
অনুরাগ জড়ানো বেশে
এই নীল জোছনায় কাছে আসবে...”

আজ আমি এতো রোম্যান্টিক মুডে কেন ! জানি না ।
এতো খুশি যে খুশির ঠেলায় কি করব তাই বুঝে উঠতে পারছি না ।
পাশে তাকিয়ে দেখি দীপ্ত ঘুমাচ্ছে ।
খুব বিরক্ত লাগল ।
শুয়ে শুয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টেরও পাই নি ।
এমন পরিবেসে ঘুম পাওয়াই স্বাভাবিক ।
হথাত আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
কেউ আমার পেট এ আদরে হাত বুলাচ্ছে ।
টের পেলাম । এটা দীপ্ত ।
বুকের ভেতরে তুফান বয়ে যাচ্ছে ।
খুব ভয় হচ্ছে আমার !
ওর হাতটা সরিয়ে আমি কেবল উঠে দাঁড়িয়েছি এমন সময় দীপ্ত আমার হাতটা চেপে ধরল .............................................

এক ঝটকায় আমাকে টেনে বসিয়ে দীপ্ত বলল,
-কই যাস ?
-কই......কোথাও নাতো ! তুই এখনও ঘুমাসনি ?
-নাহ, আসলে তোকে কিছু কথার বলার ছিল ।
-সেই বিকেল থেকে তোকে জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে । তুই তো কিছুই বলিস না ।
-আসলে.........কিভাবে যে বলি !
-শোন, বলে ফেল, না বললে থাক । আধা কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না ।
ও একটু পর বলল,
- i think i like you....
-হুম । i like you too ......এতে এতো চিন্তা ভাবনার কি আছে ?
-আরে এই like সেই like না।
-তবে ?( ন্যাকা, ঠিকই বুঝতে পেরেছি, কিন্তু প্রকাশ করছি না, গাধাটা বুঝুক আজ । 
ও চোখ দুটো বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল,
- I love u ...
আমি কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই তাকে ঠাণ্ডা ভাবে বললাম,
-হুম ।..... I love u too...বন্ধুই তো বন্ধুকে ভালবাসে । তাই না ?
আমি ভেতরে ভেতরে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাচ্ছি ।
দীপ্তর দিকে তাকিয়ে দেখি ও এবার একটু রেগে গেছে ।
আমাকে ও শুধু বলল,
-কাছে আয় ।
-আসলাম । বল ।
আমাকে অবাক করে দিয়ে গাল দুটো ধরে ও আমার ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিল ।
আমি ততক্ষনে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছি ।
হাঁটুগেড়ে ওর পাশে আমি বসে ছিলাম ।
কত তাড়াতাড়ি যে এগুলো হয়ে গেল সেটা আমি নিজেও বুঝলাম না ।
জীবনে প্রথম প্রেমের চুমু ।
আমার হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে ।
এটা কি করল দীপ্ত ?
আমি জোর করে উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে আমার রুমে আসলাম ।
সে এক অদ্ভুত অনুভূতি !
একটু ভয় আর অনেকটা ভালবাসা মেশানো অনুভূতি ।
যা শুধুই অনুভব করা যায় ।
প্রকাশ করা যায় না ।
সেদিন পুরোটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি ।
শুধু ভেবেছি কি হল এটা ?
দীপ্ত ছাদে আর আমি রুমে থেকেই সেদিনের রাতটা কাটিয়েছি ।
পরদিন সকালবেলায় ওর সাথে আমি কথা বলতে পারছিলাম না ।
এমন কি চোখে চোখও রাখতে পারছিলাম না ।
আমি যেন লজ্জায় মরে যাব এতটাই লজ্জা পাচ্ছিলাম ।
চুপচাপ ছিলাম আমি ।
ও হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরে বলল,
-কাল রাতে তুই তোর কথা আমাকে জানাস নি ।
-কোন কথা ?
-এর ভেতর সব ভুলে গেলি ?
আমি চোখ নামিয়ে নিলাম ।
কথাও বলতে পারছি না ।
ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-দেখ কাল কি হয়েছে এটা একটা এক্সিডেন্ট এর চাইতে বেশি কিছু না । আর একটা চুমুই তো ! তোর কাছে এটা ব্যাপার না । রাইট !
-ওহ তাই ? কে বলসে তোকে ?
-দেখ তোর সাথে আমি সিরিয়াসলি কথা বলছি । আজকাল আমাদের ভেতর যা হয়েছে সব বেস্ট ফ্রেন্ডদের ভেতরই একটু আধটু এমন হয় ।
ওটা এতো সিরিয়াসলি নিস না ।
ও এবার আমার দু হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
-দেখ অয়ন, আমি সত্যি তোকে ভালবাসি ।
-শুন, তুই কি বলছিস তা তুই নিজেও জানিস না । বেহুঁশ হয়ে আছিস তুই । হুঁশ ফিরলেই ভালবাসা টালোবাসা সব উধাও হয়ে যাবে ।
-অয়ন, আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি । I really love you.
-তাই না ? তা কি থেকে তোর এমনটা মনে হল ? আমাদের ভেতর তেমন কোন মুহূর্ত এসেছে কি ?
-কাউকে আমি সবসময় মিস করি,সে পাশে থাকলে আমার খুব ভালো লাগে, মনে হয় সব কিছু আমার কাছে আছে । যখনি সে দূরে যায় বুকটা এক অচিন ব্যথায় চিন চিন করে । তাকে আবার দেখতে ইচ্ছা করে । আর আমার সেইটা হলি তুই ।
কই আর কারো সাথে তো এমন হয় না ?
এবার আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম ।
কারণ পাগলটাকে তো সেই কবে থেকেই আমি ভালবাসতাম ।
কিন্তু সাহস পাইনি তাকে বলার ।
ওর এতো যুক্তির সামনে আর তর্ক করতে পারিনি ।
আসল ভালবাসা কজন পায় যে আমি পেয়েও পায়ে ঠেলব ! ওর হাতটা আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে ওর গলাতে জড়িয়ে ধরলাম । কানে কানে ফিসফিস করে ওকে বললাম,
-দীপ্ত । ভালোবাসি তোকে । অনেক ভালোবাসি । অনেক ........।।
ও আমায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ।
আরও.........।
আমরা যে কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানি না ।
তবে আমার জীবনের সবটুকু সুখ ছিল ওই মুহূর্তে ।

আমাদের জীবনটা এখন অন্যরকম হয়ে গেল ।
শুরু হল আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায় ।
একসাথে সবসময় দুজনে ।
এমনকি ওর নিজের বানানো নিয়ম ও নিজেই ভেঙ্গে একটা দু রুমের ফ্ল্যাট নিল ।
সেখানে আমরা আর আমাদের আরও দুজন বন্ধু থাকতাম ।
সারাদিন একসাথে থাকা, খাওয়া, আড্ডা, পড়াশুনা, বেড়ানো এইভাবেই বেশ কাটছিল আমাদের ।
ওর ইয়ার্কিও ছিল ঝাড়ি ।
কোন ছেলেকে দেখিয়ে যদি বলতাম,
-ওই দেখ । কি হ্যান্ডসাম না ছেলেটা !
ওর জবাব হত,
-আমায় বলিস কেন ? দেখতে ভালো হলে পিরিত কর গিয়া ।
ও আমায় সব সময় বলত,
-যার সাথে flirting করার কর । কিন্তু মনে রাখিস । তুই শুধু আমারই থাকবি ।
-তাই ? তা মশাই এই নিয়মটা আপনি মানলেই হবে । বুঝলেন ? 
-আচ্ছা । তুই কি আমায় সন্দেহ করিস ? খবরদার, একেবারে গামলা দিয়া মাইরা মাথা ফাটাইয়া ফেলুম কিন্তু ।
-ওরে বাপরে ! খাইসে রে ! আজ আমার নিস্তার নাই ! কেউ বাঁচাও আমারে ।
দেখতে দেখতে আমাদের ভার্সিটি লাইফের চার বছর কেটে গেল ।
এরপর ইন্টার্নশিপও একসাথে করেছি আমরা ।
জবের সময় অনেক চেষ্টা করেছি দুজন এক জায়গায় জব নেয়ার ।
কিন্তু হয়নি ।
তাই দুজন দুটো আলাদা ফার্মে জব করতাম ।
অনেক সময় পার করেছি একসাথে ।
কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না আমাদের মাঝে ।
প্রচণ্ড ঝগড়াও হত আবার একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যেত ।
আমাদের সম্পর্কে বন্ধুত্ব আর বিশ্বাস এই দুটোই ছিল ভিত্তি ।
আর এর কিছু স্তরে ছিল দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা বোধ আর একে অন্যের প্রতি সম্মান ।
হয়ত এগুলোর সুবাদেই আজ আমাদের সম্পর্কের পাঁচ বছর বয়স হল ।
আজকের দিনেই আমরা একে অন্যের মনের কথা জেনেছিলাম ।
দিনটা অনেক স্পেশাল আমাদের জন্য ।
আমি আগেই অফিস সেরে বাসায় ফিরেছিলাম ওর পছন্দের খাবার বানাবো বলে ।
ওর জন্য সব রেডি করে নিয়ে বসে আছি ।
ও বাসায় ফিরল হাতে একগাদা লাল গোলাপ আর ইয়া বড় একটা টেডি বিয়ার নিয়ে ।
আমি বললাম,
-আমি কি বাচ্চা ? যে আমায় টেডি দিচ্ছ ?
-হা হা হা । আরে রাখ রাখ । বলা তো যায় না যদি আমি না থাকি ? এই টেডিটা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থেক ।
আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম ।
আর রাগ করে বললাম,
-যখন তখন ইয়ার্কি ভালো না দীপ্ত ।
-ওকে বাবা । সরি । ভুল হয়ে গেছে । এই কানে ধরলাম । এখন ঠিক আছে ?
-হুম । ঠিক আছে । যাও ফ্রেশ হয়ে আস । আজ ক্যান্ডল লাইট ডিনার করব ।
-ওকে । আমি এই যাচ্ছি আর এই আসছি ।
আমরা একসাথে ডিনার শেষ করলাম ।
এরপর দুজন বেল্কনিতে গেলাম ।
বেল্কনিতে আমি গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর ও আমার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে ।
আমার কানে ঘাড়ে ওর ঠোঁট বুলাচ্ছে ।
আমি ওর দিক ফিরে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ালাম ।

এখন আমি বিছানায় ।
দীপ্তর বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি ।
ওকে বললাম,
-বড় ভয় হয় দীপ্ত । যদি হথাত তোমায় হারিয়ে ফেলি ?
-ভয় বুঝি আমার হয় না ? তুমি দেখো ! আমরা কেউ কাউকে হারাব না ।
-বিশ্বাস কর, তোমায় হারালে হয়ত মরব না । কিন্তু জীবন্ত একটা লাশ হয়ে থাকব আমি ।
-তেমনটা কখনও হবে না । কখনোই না ।
এই বলে দীপ্ত আমায় জড়িয়ে ধরে তার ভালবাসায় ভরিয়ে দিল ।
সকালে ঘুম ভাঙল দীপ্তর ফোনের আওয়াজে ।
সেই তখন থেকে ফোনটা বেজেই চলেছে ।
দীপ্ত ফোনটা তুলে শুধু হ্যালো বলল ।
আর একটা কথাও দীপ্ত বলল না ।
ওপাশ থেকে যা বলল ও সেগুলো শুধু চুপ করে শুনে গেল ।
হথাত আমায় বলল
-আমার জার্নি ব্যাগটা গুছাতে হবে ।
ওকে আজ এই মুহূর্তে বাড়ি যেতে হবে ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-কবে ফিরবে তুমি ? 
-চিন্তা করো না । তাড়াতাড়িই ফিরে আসব ।

এই বলে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে ও যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়ল ।
ওকে বাসে তুলে দিতে আমিও গেলাম বাস স্ট্যান্ড এ ।
ফোন কলটা আসার পর থেকে দীপ্তকে কেমন জানি অস্থির লাগছিল ।
কি এমন হল !
আর কার ফোন ছিল ওটা !
আচ্ছা । ওকে আমি হারাব না তো ?
ধুর কি সব বাজে চিন্তা মাথায় ঘুরছে আমার ।
আচ্ছা, ওই একটা ফোন কল আমার জীবনটা উলট পালট করে দেবে না তো ?

মনকে কিছুতেই কিছু বলে বুঝাতে পারছিনা ।
এর আগেও অনেকবার ও বাড়িতে গেছে । কই এমনতো হয়নি আমার ?
দেখতে দেখতে ওর যাওয়ার সময় হয়ে এলো ।
ও বাসে উঠার আগে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আমায় । আরেকবার ।
আমার এবার আরও খারাপ লাগছিল ।
কিন্তু ওকেতো যেতেই হবে !
ও বাসে উঠে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে ।
আমি মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে ওকে বিদায় দিচ্ছি ।
ওর চোখ দুটো ছলছল করছিল ।
এবার খুব করে মনের সন্দেহটা বেড়ে গেল ।
ও তো কাঁদার মানুষ না !
কিন্তু কি আর করব ?
বিশ্বাস আর ভরসা ছাড়া আর কিছুই করার নেই এখন ।
বাসটা যখন ছেড়ে গেল তখন মনে একটা টান লাগছিল ।
মনে হচ্ছিল একটা সুতো কেউ টেনে ছিঁড়ছে ।
বাসটা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল ততক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম ।
একাকীত্ব খুব কাজ করছিল তখন ।
চুপচাপ ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লাম ।
টেডি টা সোফায় রাখা ছিল ।

উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওটা ।
চোখ দুটো বন্ধ করে শুধু দীপ্ত কে দেখলাম ।
কিছুক্ষন হল । অথচ এতো মিস করছি ওকে যে বলার মত না ।
সারাটা দিন এটা সেটা করে কেটে গেল ।
দীপ্ত একবারও ফোন করল না ।
সারাটা দিন ফোনেও ওকে পাওয়া গেল না ।
ভাবলাম চার্জ নেই । তাই হয়ত ফোনটা বন্ধ ।
দুইদিন কেটে গেল ।
চারদিন কেটে গেল ।
দীপ্তর কোন খবর নেই ।
এবার চিন্তা লাগল ।
কোথায় খুজিনি ওকে !
ফেসবুক, ওর ফোন, অফিস সবখানেই খুজেছি ।
কোথাও কোন খবর নেই ।
যেন হারিয়ে গেছে ও ।
একা হয়ে গেলাম আমি ।
অদৃষ্টের পরিহাসে সেই থেকে একাই থেকে যাব এটা ভাবিনি ।
দীপ্ত আমার সাথে এমন করতে পারল ?
আমি ভাবতে পারছি না ।

তিন মাস কেটে গেল ।
ওর কোন খবর নেই ।
ওর অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি কেউ ঠিক মত কিছুই বলতে পারে না ।
কেউ বলে ওর বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ বলে ও বিদেশ গেছে আবার কেউ বলে ও অন্য কোথাও চাকরি নিয়েছে ।
একবার ওর বাড়িতে গেলাম ছুটি নিয়ে ।
কিন্তু কারো কোন হদিস পেলাম না ।
কিন্তু গিয়ে এটা জেনেছিলাম যে দীপ্ত বিয়ে করেছিল ।
এটা অনেক বড় একটা ধাক্কা ছিল আমার জন্য ।
তখন থেকে আর পিছু ফিরে তাকাইনি ।
তেমনি আর অপেক্ষাও করিনি ।
একটা দুঃস্বপ্ন ভেবেই সব ভুলে গিয়েছিলাম ।
কিন্তু দুঃস্বপ্ন এতো মধুর হয় কি করে ?
না । এগুলো সব সত্যি ছিল ।
দুঃস্বপ্ন নয় ।

এই দেখো ।
পুরনো স্মৃতির বই পড়তে পড়তে সবটুকু পড়ে শেষ করলাম ।
আর কোন স্মৃতি বাকি নেই ।
হুট করে চোখটা ঘড়ির কাঁটায় গিয়ে পড়ল ।
চারটা বাজতে চলেছে ।
অফিস শেষ । তাই তাড়াহুড়ো করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ।
আজ প্রায় ছয় বছর পর আবার ওকে দেখব ।
আচ্ছা । আমি এখনও ওকে এতো ভালোবাসি !
নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি ।
বাসায় গিয়ে রেডি হয়ে সাড়ে পাঁচ টার দিকে লেকে পৌঁছে দীপ্তকে ফোন দিলাম ।

-কই তুমি ?
_এইতো এসেই গেছি । তুমি কি পৌঁছে গেছ ?
-হ্যাঁ । আচ্ছা আমি তোমায় চিনব কি করে ? মানে কি পরে আছ তুমি ?
-না বললে চিনতে পারবে না ?
-ঠিক তানা । বলে দিলে চিনে নিতে সুবিধে হবে আর কি !
-ওহ । শুন । আমি ব্ল্যাক চেক শার্ট, জিন্স পরে আছি । আর চোখে একটা সান গ্লাস ।
-ঠিক আছে তুমি এসো, আমি লেকের একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছি ।
অপেক্ষা করছি আর ভাবছি ।
“ভাবলাম গাধাটা আগে এসেছে কিন্তু সেই তো লেইট, ধুর.........”
অপেক্ষা করতে আমার ভালো লাগে না ।
কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয় ।
মিনিট সাতেক পর দেখলাম একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে ।
-দীপ্ত ?
-হুম (সানগ্লাস খুলতে খুলতে বলল)। যাক চিনতে পেরেছ তাহলে ?
-ফোনেই তো বলে দিলে কি কি পরে আসবে । সেজন্য চিনতে পারলাম ।
-ওহ । নাহলে বুঝি চিনতে না ? হা হা হা ।

অনেকদিন পর দীপ্ত আর ওর হাসি দেখছি আমি ।
বেশ ভালো লাগছে আমার ।
বেশ মোটা হয়ে গেছে ও ।
শরীরের কোন যত্ন নেয় না এটা বেশ স্পষ্ট ।
চোখে মুখে কেমন যেন একটা মলিনতার ছাপ ।
এই দীপ্তকে তো আমি চিনি না ।
চুপচাপ আছি আর মনে মনে এগুলো ভাবছি আমি ।
অনেকদিন পর দুজনের দেখা হল । তাই ওর সাথে খুব একটা সহজভাবে মিশে কথা বলতে পারছিলাম না ।
পুরনো ব্যথা একটু একটু করে যেন জেগে উঠছে ।
দীপ্ত বলল,
-তা কেমন আছ ?
-হুম । ভালো। তুমি ?
-আমার আর থাকা । তুমি দেখি অনেক পালটে গেছ । আগে থেকে অনেক বেশি ইয়ং লাগছে তোমায় ।
-হুম । তুমিও অনেক পালটে গেছ । মোটা হয়ে গেছ । আগের মত আর কথায় কথায় হাসো না ।
-হ্যাঁ । আমার হাসিটাকেই যে হারিয়েছি ছয় বছর আগে ।
তোমায় কিছু বলার ছিল।
-বল, শুনছি ।
-আমাকে ক্ষমা করে দিও । কারণ আমি পারিনি আর ফিরে আসতে । পারিনি আর তোমার খবর নিতে । জানি নিজের অজান্তেই প্রতারনা করেছি তোমার সাথে । কিন্তু তাতে মোটেই আমার কোন ইচ্ছে ছিল না ।
-কি লাভ ? কি লাভ ওগুলো বলে বলতো ? আমি সব ভুলে গেছি । জীবনে মানুষকে একাই পথ চলতে হয় আর সে অভ্যাসে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি । আর তাই কষ্টগুলো ইদানিং গায়ে লাগে না ।
-আমি চাইলেই পারতাম অয়ন । পারতাম তোমার সাথে যোগাযোগ করতে । কিন্তু আমার লজ্জা বেশি আর সাহস কম ছিল । কোন মুখে তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব ?
-থাক । ওগুলো আর জানতে চাই না ।
-অয়ন । তুমি বিয়ে করেছ ?
-হথাত এই প্রশ্ন ?
-না । মানে বাড়ি থেকেত এতদিনে ঠিকই চাপ দিচ্ছে বোধহয় । তাই আর কি ।
-তা তুমি কি এক্সপেক্ট করেছিলে ? আমায় বিবাহিত পাবে ?
-আসলে কি বলতো...........
-থামো । শুন আমি সত্যকে ভয় পাই না । আর বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি বিয়ে করব না । বংশে একজন ব্যাচেলর থাকলে কারোরই কিছু যায় আসবে না । লাইফটা আমার । তাই সিধান্ত টাও আমার ।
-ওহ । জানতে চাইলে না তো আমার বিয়ে হয়েছে কি না ?
-তোমাকে যে বিবাহিত পাব তেমনটা আশা করিনি । তাই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি ।
-সেদিন যে আমার উপর কি গেছে তা হয়ত আমিই জানি । তুমি জানো ? সেদিন বাড়ি গিয়েছিলাম কি জন্য ?
-কি জন্য ?

-গিয়ে দেখি মা শয্যাশায়ী । উনার ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে করতে বাধ্য হই আমি । আমার উপর দিয়ে যে কি ঝড় গেছে সেটার কোন সীমা নেই ।
- হুম । কিন্তু একটা বার দেখা তো করতে পারতে ? যোগাযোগও বন্ধ করে দিলে তারপর । উফ ফ ফ ফ...। বাদ দাও তো এসব । তারপর বল, বিয়ে করে বেশ সুখে আছ তাহলে !
-হুহ । আর সুখ ! শুধুই তার দেহ নিয়ে খেলেছি এই কটা বছর । কিন্তু মনটা কিছুতেই তাকে দিতে পারিনি ।

মাথা নিচু করে ওর কথাগুলো শুনছিলাম । চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গালে নামার আগেই তা মুছে ফেলে বললাম ,
-থাক না এসব কথা । পুরনো কথা নিয়ে আর বেশি নাড়াচাড়া করতে চাই না । তুমি ভালো আছ । থাক । এটাই তো চেয়েছি সবসময় । তা খালাম্মা কেমন আছেন এখন ?
-মা ভালো আছেন ।
-সন্ধ্যে হয়ে আসছে । কাল আবার অফিসে অনেক কাজ । আমি যাই । ভালো থেকো ।
-বাকি কথাগুলো শুনবেনা তুমি ? এতো রাগ আমার উপর ?
-রাগ তাদের উপরেই করা যায় যাদের উপর অধিকার থাকে । আর আমি সেটা হারিয়ে ফেলেছি । যাই হোক । ভালো থেকো ।
এই বলে চলে আসতে লাগলাম । এমন সময় দেখি একজন মানুষ দেড় বছরের ছোট একটা ফুটফুটে মেয়েকে কোলে নিয়ে দীপ্তর কাছে এগিয়ে যাচ্ছে আর বলছে,
-স্যার । আম্মাজান খুব কানতাসে আপনার কাছে যাইব মনে হয় ।
দেখলাম দীপ্ত পরম যত্নে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিচ্ছে । মেয়েটা ওর কোলে গিয়ে শান্ত হল । কৌতূহল নিয়ে দীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কে ও ?
-আমার মেয়ে ।
-ও ! কি নাম ওর ?
-অথৈ । জানো , ওর নামটা তোমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা ।
-হুম । তা তোমার ওয়াইফও এসেছে নিশ্চয়ই ! পরিচয় করাবেনা ?
-সেটা আর সম্ভব না !
বলেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল দীপ্ত ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-কেন ? ও ! আমার পরিচয় তো দিতে পারবে না তাই না ?
-না তা নয় । অথৈ এর জন্মের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণে ও মারা যায় ।
-I'm extreamly sorry...
বলে আরও একবার অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম দীপ্ত কে ।
এই মানুষটাকে কি আজও চিনেছি আমি ?
নাকি অচেনাই রয়ে গেছে সে ।
ভাবতে ভাবতে অথৈ এর দিকে চোখ পড়ল ।
কি মায়া মাখা মুখটা তার ।
চোখ দুটো যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
দীপ্তকে বললাম,
-ওকে (অথৈ) আমি একটু কোলে নিতে পারি ?
-তুমি নেবে ওকে কোলে ?

কোন কথা না বলে দীপ্তর দিকে তাকিয়ে আছি ।
এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম ।
মুখটা দেখে যে কারোরই মায়া লাগবে ।
কি নিষ্পাপ মুখ !
কিন্তু কি ভাগ্য ওর!
জন্ম থেকেই মা হারা সে ।
খুব খারাপ লাগছিল ওর জন্য । দীপ্ত আমায় ডেকে বলল,
-অয়ন, আজ একটা জিনিস চাইব । দেবে ?
-কি চাও বল ?
-অনেক আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি । আমায় ফিরিয়ে দিও না প্লিজ । আমরা কি পারি না আগের মত করে জীবনটা শুরু করতে ?
-এ আর হয়না দীপ্ত । সবকিছু কি সব সময় এক তরফা হয় ? বল । যখন খুশি কাছে টানলে, ইচ্ছে হল ছুঁড়ে ফেলে দিলে । মন চাইল আর অমনি তুলে নিলে । এমন হয়না দীপ্ত । এমনটা হয় না ! আমি যাই ।
কথা শেষ করেই অথৈকে দীপ্তর কোলে দিলাম ।
আর আমি জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম ।
পেছন থেকে দীপ্তর ডাক শুনতে পাচ্ছি ।
-অয়ন.........কেন এটা হয়না......অয়ন, প্লিজ এমন করো না......অয়ন......
আমি আরও জোরে হাঁটছি ।
বেশ খানিকটা দৌড়ে চলে এসেছি ।
বুকের ভেতরটা কেন জানি ফাঁকা হতে লাগল ।
এখন খাঁ খাঁ করছে বুকটা ।
মনে হচ্ছে আজ আমার কিছুই নেই ।
আমি আর একটা ধাপও ফেলতে পারলাম না ।
হাঁটা থামিয়ে ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকালাম ।
দেখলাম দীপ্ত অথৈকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ।
আর থাকতে পারলাম না ।
এবার হাঁটতে হাঁটতে দৌড় দিলাম ।
দীপ্তর কাছে এসেই ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি আর বলছি,
-পারলাম না । তোমায় ছেড়ে যেতে পারলাম না ।
-আমি জানতাম তুমি পারবেনা । তুমি ফিরবে । বিশ্বাস কর আমি মন থেকে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি ।
-ইস ! আমি জানি । কিছু বলতে হবে না তোমায় ।

আমাদের কান্নার মানে অথৈ বুঝল কিনা কে জানে ?
কিন্তু সেও কাঁদছে ।
তিন জনই কাঁদছি ।
কেমন একটা শান্তি লাগছিল ওর কান্নায় ।

একটু পর দীপ্তর সেই কেয়ার টেকার এল ।
আমি চোখ মুছে স্বাভাবিক গলায় দীপ্তকে বললাম অথৈকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে থেকে যেতে ।
ও রাজি হল ।
কেয়ার টেকার কে বিদায় দিয়ে আমরা ঘুরে বেড়ালাম আর ডিনারটা বাইরেই সারলাম ।
রাত ৮ টার দিকে বাড়ি ফিরলাম । অথৈ ঘুমিয়ে গেছে তাই ।
আজ আবার সেই রাত ৮ টার কথা মনে পড়ল ।
সেই সব পাগলামি ।
খুনসুটি ।
সব আমার চোখ এর সামনে ভেসে উঠল ।
ড্রয়িং রুমে দীপ্তকে বসিয়ে আমার রুমে অথৈকে শুইয়ে দিলাম ।
ফ্রিজে রাখা কেকটার কথা মনে হতেই ওটা নিয়ে ড্রয়িং রুমে এলাম ।
দীপ্ত কেক দেখে বলল,
-আরে...।। তোমার জন্য তো কোন গিফটই কেনা হয়নি !
-তাতে কি ? এই বার্থ ডে টা আমার সব থেকে স্পেশাল । কারণ আজ আবার তোমায় ফিরে পেলাম । সাথে পেলাম ঐ ঘুমন্ত ছোট পুতুলটা । এর চাইতে ভালো গিফট আর হতেই পারে না ।
-তুমি আমায় এতো ভালবাস ?
-ঐ । আমাকে সন্দেহ কর ? মাথা ফাটাব কিন্তু গামলা দিয়ে বাড়ি মেরে ।
-ওহ হ ।। তাই তো !
দুজনেই হা হা করে হেসে উঠলাম ।
কেক কেটে দুজনেই খেলাম ।
আমি মজা করে বললাম,
-এই যে মিস্টার । এবার আপনার মেদ ঝরাতে হবে । খাওয়া দাওয়া একটু কম করেন । যেভাবে বলব সেভাবে চলবা বুঝছ ? নাহলে কিন্তু গামলা ট্রিটমেন্ট চলবে ।
-ওপস স স স ।জ্যা স্যার । যথা আজ্ঞা ।
ড্রেস চেঞ্জ করে আমরা শুয়ে পড়লাম ।
১০ টার দিকে ।
আচমকা অথৈ এর কান্নায় ঘুম ভাঙল ।
ওকে কোলে নিয়ে ছাদে গেলাম ।
তখন রাত ১১ টা ৪৫ বাজে ।
আজ পূর্ণিমা না হলেও চাঁদ যেন আলোর পসরা বসিয়ে রেখেছে ।
এই সময়ে এতো ব্যস্ত শহরটা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছে ।
অথৈকে নিয়ে পায়চারি করছি এমন সময় ছাদের দরজায় একটা শব্দ ।
ঠক ঠক ।
আমি বললাম,
-কে ?
-আমি (নাকি সুরে বলল)
-দীপ্ত, মানুষ এক ভাবে একবারই বুদ্ধু হয় । সামনে আসো ।
-এখন আর ভয় পাও না ?
-নাহ । আমার সুপারম্যান থাকতে আবার ভয় কি ? হা হা হা ।
সেদিনের রাতের কথা মনে পড়ছিল ।
আজ আমার কানে হেড ফোন নেই । সেই চাঁদ টা নেই । কিন্তু আমার সাথে আজ দীপ্ত আছে । এতটা বছরের প্রতি টা ক্ষণ এই মুহূর্ত তাকে পেতে কাতর হয়ে ছিলাম আমি ।
দীপ্ত পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমায় বলল,
-সময়টা এখানে থেমে গেলেই মন্দ হয়না বলো.........।
-হুম । খুব ভালো হত ।কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না । তবে আমরা চাইলেই থেমে থাকতে পারি । তাতে সময়ের পরোয়া করতে হয়না ।
-থাকব । আমরা এভাবেই থেমে থাকব । এভাবেই একসাথে বেঁচে থাকব আমরা ।
এটা বলেই দীপ্ত আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুয়াল ।
এতো বছরের পর ওর ঠোঁটের উষ্ণ চাওয়া পেলাম ।
আমার কানে কানে চুপটি করে বলল,
-অয়ন, ভালোবাসি । আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি ।
-পাগল টা । আমিও জ্যা তোমায় অনেক ভালোবাসি ।
দুজন ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছি ।
বড়ই আজব এই ভালবাসা !
কখনও পাইনি, কখনও পেয়েছি, কখনও হারিয়েছি আবার কখনওবা পেয়েছি ।
এই পাওয়া না পাওয়ার খেলায় নিজে যত কিছু হারিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পেয়েছি । অনেক বেশি কিছু ।
এই মুহূর্তে কোন গান নয় ।
চিরাচরিত রূপকথার গল্পের শেষ লাইন টা মনে পড়ছে,
“অতঃপর তাহারা দুজন সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল...............” । 



কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?