ভারতে যখন সেকশন-৩৭৭ কার্যকর করার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছিলো, তখন অসংখ্য ভারতীয় লেখক-অধ্যাপক-সামাজকর্মী থেকে শুরু করে অনেক সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীকেও দেখেছি অনলাইনে, লেখায় প্রতিবাদের ঝড় তুলতে। এমনকি সে দেশের প্রথম সারির পত্রিকা ‘টাইমস অভ ইন্ডিয়া’ প্রকাশ্যেই সমকামীদের সমর্থন দিয়েছে এ আন্দোলনটিকে। মুম্বাই মিরর নামে মুম্বাইভিত্তিক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় দেখেছি সমকামী সন্তানের অভিভাবক নিয়ে উৎসাহব্যাঞ্জক সাক্ষাৎকার। এমনকি ওদেশের প্রখ্যাত এক গহনা প্রস্তুত ও বিপননকারী প্রতিষ্ঠানও সাহস দেখিয়েছে সমকামীদের অধিকার রক্ষায় সমর্থন দেবার। এর বাইরেও আরো অনেক ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া সমকামীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই সব লেখক, ছাত্র, মিডিয়াকর্মী – প্রতিবাদীদের দলে যে কেবল সমকামী এবং তাদের স্বজনেরা ছিলো তা-ই নয়, বরং অসংখ্য বিষমকামী মানুষেরাও ছিলো। কি লাভে? উদ্দেশ্য একটাই, মানবাধিকার রক্ষা। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সব নাগরিকদের সমান অধিকার নিশ্চিত করাই ছিলো তাদের লক্ষ্য। এবার নজর দিই আমাদের নিজেদের দেশে। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সাথে আমাদের বহু বছরের সম্পর্ক-সংসর্গ থাকলেও তাদের সাথে আমাদের কিছু মৌলিক পার্থক্যও আছে। এদেশে জ্ঞানীলোকের অভাব নেই, মানবতার রক্ষক দাবীদারেরও কোন কমতি নেই। অথচ আজ পর্যন্ত কতদিন এদেশের কতজনকে সমকামীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছেন?
হ্যাঁ, সাম্প্রতিককালে হিজড়া সম্প্রদায়ের “স্বীকৃতি” নিয়ে এদেশবাসীকে বেশ “উদার” হতে দেখা গেছে। এই স্বীকৃতির মানে হলো, একজন হিজড়া যে নারীও নন, পুরুষও নন, সেটা কাগজে কলমে লিখতে পারার স্বীকৃতি এবং তাদের ভোটাধিকার। ব্যাস! যৌন সংখ্যালঘু, অর্থাৎ LGBT Community’র সদস্যের অধিকার রক্ষায় এটুকুই বাংলাদেশের অগ্রগতি। আপাতদৃষ্টিতে এটুকুকেই “যথেষ্ঠ অর্জন” বলে মনে হলেও, এর পেছনে রাজনীতির সুক্ষ্ণ একটি প্যাঁচ আছে। Transsexual, অর্থাৎ হিজড়াদের প্রতি সমাজ যতটা দয়া দেখাতে প্রস্তুত, সমকামী বা রুপান্তরকামীদের ক্ষেত্রে কিন্তু তার কিছুমাত্রও না। প্রথম কারণ, ধর্মীয়। মুসলিমপ্রধান এই দেশে সমকামীদের অধিকার তো দূর, স্বীকৃতি প্রদানও রীতিমতো অসম্ভব। কারণ ইসলাম কোনরকম রাখঢাক ছাড়াই সরাসরি সমকামের বিরোধীতা, এমনকি সমকামীদের কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে। এবং রুপান্তরকামীদের “অভিশপ্ত”, “স্রষ্টার বিরোধীতাকারী” বলে উল্লেখ করেছে। সে তুলনায় জন্মগতভাবে উভলৈঙ্গিকদের ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চুপ থেকে দায় সেরেছে। কারণটি হলো উভলৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো শারীরিকভাবে দৃশ্যমান, তাই একে “মানুষের কোন হাত নেই” এবং “স্রষ্টার বিচিত্র খেয়াল” বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সমকামিতা বা উভকামীতার ব্যাপারগুলো প্রধানত মনস্তাত্বিক এবং দৃশ্যমান শারীরিক কোন বৈশিষ্ট্য নয় বলে সেটিকে “ব্যাক্তির ইচ্ছাকৃত বিকৃতি” নাম দেগে কঠোরভাবে দমনের বিধান দেয়া হয়েছে। যেহেতু ধর্মের ক্ষেত্রে “বিশ্বাসে মিলায় বস্ত, তর্কে বহুদূর” মতাবাদই প্রধান, অর্থাৎ যুক্তি-তর্কের চেয়ে অন্ধবিশ্বাসই প্রাধান্য পায়, তাই হাজার বছরের পুরনো মতবাদ, বিজ্ঞানের যুগে সেটা যতোই ভুল প্রমাণিত হোক না কেন, ধর্মভীরুরা তার কোনরকম পরিবর্তন মানতে প্রস্তুত নন। সেকারণেই এদেশবাসী সমকাম নিয়ে কোনরকম আলোচনা করতেও আগ্রহী না। কারণ তাদের মতে “বিধান” তো হাজার বছর আগেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, মোটামুটিভাবে ধর্মীয় কারণটি এই, যদি সমকামীদের স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া হয় এবং তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়, তাহলে ধর্মের “আদি, অকৃত্রিম, নির্ভুল এবং অপরিবর্তনীয়” ইমেজটি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে, ফলে অবধারিতভাবেই ধর্মের অন্যান্য দিকগুলোর যৌক্তিকতা নিয়েও মানুষ প্রশ্ন তুলতে থাকবে এবং চূড়ান্ত পরিনামে অন্ধবিশ্বাসের ভিতটি একেবারে নড়ে গিয়ে ধর্মব্যাবসার অস্তিত্বটিকেই হুমকিতে ফেলে দেবে। সেটি বুঝতে পারে বলেই ধর্মের সেবকেরা এ সম্পর্কিত যে কোন কথা-বার্তা বা যুক্তি-তর্কের সুযোগ দিতেও প্রস্তুত না। এবং এই ধর্মীয় কারণেই অনেক সমকামীও, যারা যৌনসম্ভোগে সিদ্ধহস্ত (এদেশে মক্তব-মাদ্রাসার সমকামী মোল্লা এবং ভ্যাটিকানভিত্তিক ক্যাথলিক চার্চগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনা করুন), তারাও সমকামের শারীরিক তৃপ্তি উপভোগে যত বেশি সচেষ্ট, ধর্মীয় বিধানগুলোর যৌক্তিকতা আলোচনার বেলায় ঠিক ততটাই বিপরীতমুখী। তাই সমকামীতাকে পাপ বলে জেনে নিয়েই তারা শিশুনিপীড়নের মতো জঘন্য অপরাধগুলোতে লিপ্ত হয়। অথচ যুক্তির আলোয় দেখে বিকল্প যৌনতাকে যদি স্বাভাবিকভাবে নেয়া হতো তাহলে শিশুকামের মতো বিকৃত মানসিকতাকেও রোধ করা যেতো ।
দ্বিতীয় কারণটিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি শিক্ষার অভাব বলে। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার “এ-প্লাস”-এর সংখ্যা দেখে এবং স্বাক্ষরতার হার দেখে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। ভাবি, দেশ শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মানে যে কেবল বছর বছর পাশ দিয়ে দিয়ে বড় নোকরী করাই না, শিক্ষিত হওয়ার মানে যে আরো অনেকটুকু উদার মন গড়ার এবং পৃথিবীর বৈচিত্র সম্পর্কে জানার-বোঝার সক্ষমতা; এই অশিক্ষিত, দারিদ্র্য জর্জর দেশটির মানুষ হিসেবে আমরা প্রায়ই সেকথা বেমালুম ভুলে বসে থাকি। সেকারণেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে ধীরে ধীরে হলেও যতোটা উন্নতি করতে পারছি, নৈতিক দিকটি আমাদের ততটা বিকশিত হচ্ছে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, জাতিগত ভাবে আমরা খুব একটা পড়ুয়া নই। স্কুল-কলেজের দু’চারটে পাঠ্যবই, কিছু দৈনিক পত্রিকা আর দু’একটা জনপ্রিয় প্রেমের উপন্যাস ছাড়া আমাদের দেশের নাগরিকদের সিংহভাগই অন্য কোন বইয়ে হাত ছোঁয়ান না। অথচ মনের ওদার্য্য এবং জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য পড়ার কোনই বিকল্প নেই। সুশিক্ষিত মানব হবার প্রধান শর্তই হলো, প্রচুর পড়াশোনা থাকা। ভারতের যে আন্দোলনটির কথা শুরুতে বলা হলো, রুঢ় বাস্তবতা হলো, শুধুমাত্র শিক্ষিত মধ্যবিত্ত/উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজেই সেটি সাড়া জাগাতে পেরছে। আন্দোলনকারী এবং সমর্থনকারীদের সিংহভাগই উচ্চশিক্ষিত। গোটা ভারতবর্ষের বিশাল অল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠির কাছে মানবা্ধিকার রক্ষার এই আন্দোলন তার বার্তা পৌঁছে দিতে খুব বেশি সফল হয় নি। তাই আন্দোলনটির গায়ে না চাইলেও “Elitist” তকমা লেগে গেছে। এমন নয় যে আমাদের দেশে সুশিক্ষিত নাগরিক একেবারেই নেই। তবে বিশাল বড় দেশ ভারতের বড় বড় শহরগুলোর শিক্ষিত সজ্জনেরা সমকামীদের সম-অধিকারের প্রশ্ন যেভাবে জাতীয়পর্যায়ে একজোট হতে পেরেছিলেন, আমাদের দেশে সেটা কখনোই সম্ভব হয় নি।
তৃতীয়ত, ধর্ম এবং শিক্ষার অভাব বাদ দিলে, যদি সামাজিকভাবেও আমরা চিন্তা করি, তাহলেও দেখতে পাবো, মোটামুটি উদারপন্থী নাগরিকেরা, যারা ততটা ধর্মভীরু নন, ব্যাক্তিজীবনে যারা ধর্মকে খুব বেশি না জড়িয়ে একটি আধাআধি সুবিধাজনক সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং নিদেনপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক পর্যায় ডিঙ্গিয়ে সমাজের সচেতন নাগরিকের পদটি দখল করে আছেন, তারাও সমকামের বিরুদ্ধে প্রচন্ড সোচ্চার। যদিও হিজড়াদের ব্যাপারে কিছুটা নরম বলেই মনে হয় তাদের। কেন এই দ্বিমুখী অবস্থান বিকল্প যৌনতার ব্যাপারে? অপ্রিয় হলেও সত্যি, হিজড়ারা এই সমাজ থেকে বিতাড়িত, পৃথককৃত। তাই সমাজের অধিবাসীদের সাথে স্বার্থগত প্রতিযোগীতা বা দ্বন্দ্ব তাদের কম। আর্থিক বা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কোন হিজড়ার কথা এদেশের নিকট ইতিহাসে সহজলভ্য না। তার কোনরকম সুযোগ সমাজ রাখে নি। চাকুরী, ব্যাবসা - কোনক্ষেত্রেই কোন হিজড়াকে আপনি প্রতিদ্বন্দী হিসেবে পাবেন না। সুবিধাবাদী সমাজটি বহু আগেই ঠান্ডা মাথায় সে সম্ভাবনাটি নষ্ট করে দিয়েছে। নাচা-গাওয়া ছাড়াও যে হিজড়াদের অন্য কোন মেধা থাকতে পারে এবং সামান্য সুযোগ পেলেই অন্য যে কোন মানুষের মতোই মেধার স্ফুরণ ঘটতে পারে, সেটা সমাজ মানতে নারাজ। শারীরিক গঠনগতভাবে আলাদা হওয়ায় এবং বাহ্যদৃষ্টিতেই আলাদা করতে পারায় সমাজ অঙ্কুরেই তার সমস্ত সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দেয়। তাই মুখে মুখে যতোই তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি এবং ভোটাধিকার দিয়ে করুণা দেখাক না কেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনোই হিজড়াদের নিজের সমতুল্য মানুষ ভাবতে প্রস্তুত না। কিন্তু সমকামীরা যেহেতু সমাজের মূলধারারই মানুষ, তাদের যেহেতু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আলাদা করতে সমাজ অসমর্থ, তাই একজন সমকামী শিক্ষা-দীক্ষায় একজন বিষমকামী্র সমান সুযোগ-সুবিধা পান এবং ফলশ্রুতিতে ক্যারিয়ার বা অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই বিষমকামীদের সাথে প্রতিযোগীতা করতে সক্ষম, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তার বিষমকামী প্রতিদ্বন্দীর চেয়ে অধিক সফল হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক, মেধাগত সকল দিকেই একজন সমকামী অন্য একজন বিষমকামীকে টেক্কা দিতে পুরোপুরি সমর্থ। হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটি, শিল্পজগতের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পীটি, মেধাবী খেলোয়াড়, অভিনেতা কিংবা ডাক্তারটি, অথবা সফল ব্যাবসায়ী/উদ্যোক্তাটি - আপনার চারপাশেই হয়তো এমন অনেক সম্ভাবনাময় মানুষগুলো আছেন যারা সমকামী। আমাদের দেশে কেউ প্রকাশ্যে আসেন না বলে আমরা জানতে পারি না। কিন্তু যেসব দেশে মানুষ নির্ভয়ে তার Sexual Orientation-এর দিকটি প্রকাশে সক্ষম, সেখানকার ইতিহাস কিন্তু বলে যে সমকামীরা প্রকৃতিগতভাবেই বেশি অনুভূতিপ্রবণ এবং সৃষ্টিশীল। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, যার প্রতিভা দেখে এখনো মানুষের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না, সেই ষোড়শ শতকেই যিনি বিমানের নিখুঁত ডিজাইন করেছিলেন, যাকে বলা হয় একই সাথে চিত্রকলা, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, গণিত এবং দর্শনের অপার বিস্ময়, তিনি একজন সমকামী ছিন। পশ্চিমা সঙ্গীতজগতের প্রবাদপুরুষ স্যার এলটন জন একজন সমকামী। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন অকৃত্রিম বন্ধু বিখ্যাত আমেরিকান কবি এলেন গিনেসবার্গ একজন সমকামী। ওপার বাংলার মেধাবী চিত্রনির্মাতা প্রয়াত ঋতুপূর্ণ ঘোষের কথা আমরা সবাই জানি। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। অর্থাৎ, বিষয়টি দাঁড়ালো যে, সমকামীরা বিষমকামীদের করুণা ছাড়াই তাদের সাথে টেক্কা দিতে প্রস্তুত বলেই বিষমকামীরা সমকামীদের উপর খড়্গহস্ত। তাদের মতো নন, অথচ তাদের সমান সমান কাজ করতে, সাফল্য পেতে সক্ষম, এমন কাউকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সহজে ছাড় দিতে প্রস্তুত না। নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্বটি এত সহজে নারী বা সমকামীদের হাতে নত হতে দিতে পুরুষতন্ত্র কিছুতেই চাইবে না, এটাই সত্য। হিজড়াদের ক্ষেত্রে যেহেতু সাফল্যের সব পথ শুরুতেই রুদ্ধ করে দেয়া হয়, সমান সমান হয়ে ওঠার সবটুকু সম্ভাবনার গোঁড়াতেই নুন ঢেলে দেয়া হয়, তাই তাদের নিয়ে দু’চারটে টুকটাক করুণামিশ্রিত মিষ্টি কথা বলতে তেমন কোন ক্ষতি নেই। এটাই হলো সামাজিক কূটচালের দিকটি।
হিজড়াদের চোখের সামনে “স্বীকৃতি” নামক মুলাটি ঝুলিয়ে দিলেও সমকামীদের ব্যাপারে কট্টর অবস্থানে থাকার রাজনৈতিক ব্যাখাটিও বেশ মজার। আমাদের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি হলো আপাতঃপ্রগতিশীল আওয়ামি লীগ এবং প্রগতিবিরোধী জামায়াত সমর্থিত দল বিএনপি। জামায়াত-বিএনপি যেহেতু প্রগতির ধার ধারে না, মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র গঠন করাই যেহেতু তাদের মূলনীতি, তাই তারা হিজড়া বা সমকামী কোনকিছু নিয়েই আপাতত মাথা ঘামায় না। আওয়ামিলীগ যেহেতু প্রগতিশীলতার দাবিদার, অথচ আধুনিক বিশ্বে কোন হোমোফোবিককে প্রগতিশীল বলা অসম্ভব, আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সমকামী বা উভকামীদের নিয়ে কোনরকম কথা বলাই জনপ্রিয়তা হারানোর জন্য যথেষ্ঠ, তাই এই রাজনৈতিক দলটি এমন একটি বিষয়ের অবতারণা করলো যাতে বহিঃবিশ্বে নিজেদের উদার-মানবতাবাদী ভাবটিও বেশ বজায় থাকে, আবার দেশের রক্ষণশীলদের তোপের মুখেও পড়তে না হয়। অর্থাৎ সাপও মরলো, আবার লাঠিও ভাঙলো না।
চতুর্থত, বলতে দ্বিধা নেই, বৈচিত্র্য এবং বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করার মানসিকতার অভাব এদেশে প্রচণ্ড। আমাদের এই ছোট্ট দেশটি দুভার্গ্যজনকভাবে জাতিগত-ভাষাগত-সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত। যে অল্প খানিক বৈচিত্র্য আছে আমাদের, সেটুকুর অস্তিত্বও মৌলবাদীদের হুমকির সামনে ক্ষয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। বৈচিত্র্যকে, ভিন্নতাকে মেনে নেয়ার মানসিকতা আমাদের অনেক কম বলেই সহনশীলতাও আমাদের অনেক কম। পৃথিবীর যে কোন শহর বন্দরের তুলনায় আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম অনেক কম কসমোপলিটন, বাকি দেশের কথা নাই বললাম। এদেশে এক গ্রামে ভিন গাঁয়ের লোককে বলা হয় বিদেশী, এক জেলায় অন্য জেলার লোককে খানিকটা হলেও বাঁকা চোখে দেখা মানুষের অভাব পড়ে না কখনোই। এখনো আদিম সমাজের অনেক ত্রুটিই আমাদের মাঝে বিদ্যমান। আধুনিক, বৈচিত্র্যময় সমাজ হতে এখনো অনেক দেরী। মৌলবাদ শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই না, আমাদের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রকট। শুদ্ধবাদিতা কখনোই কোন সমাজের জন্য মঙ্গল আনতে সক্ষম নয়। শুদ্ধবাদীতা কেবল গোঁড়ামী এবং অন্যদের প্রতি ঘৃণাই উস্কে নেয়। যে সমাজ বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করতে যত বেশি সক্ষম, সে সমাজ তত বেশি আধুনিক, তত বেশি মানবিক। যে সমাজ ভাষাগত-জাতিগত-ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করতে অসমর্থ, সে সমাজের কাছে বিকল্প যৌনতার গ্রহণযোগ্যতা আশা করা পুরোপুরি বাতুলতা। তবে কি এদেশের সমকামী বা বিষমকামী সমাজের সামনে কোনই আশা নেই, “স্বাভাবিক মানুষ” স্বীকৃতি পাবার? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য হয়তো আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে আমাদের। দেশটি যদি একটি ধর্মসর্বস্ব, তথাকথিত শুদ্ধবাদী সমাজ হয়েই বেড়ে ওঠে, জনবহুল দেশটির বেশ বড় সংখ্যার সমকামী সদস্যরা যদি নামমাত্র শিক্ষিত এবং নিজের যৌনতাকে, আগ্রহ-ভালোবাসাকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করতে অসমর্থ হয় তবে আমাদের ভাগ্যে মধ্যএশিয়ার মধ্যযুগীয় পরিণতিই অপেক্ষা করবে, যেখানে ভালোবাসা মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ বলেই গণ্য হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন