২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

অবধারিত নিয়তি

-আমাদের সম্পর্কের এইখানেই সমাপ্তি। 
-মানে কি? 
-মানে সোজা, মামলা ডিসমিস। ফোন কাটার পর থেকে আমি তোমাকে চিনি না। 
-ফাহিম, জানি তুমি মজা করছ। তুমি পারো ও বটে। 
-না একদমই না। আমি সিরিয়াস। 
-তুমি সিরিয়াস মানে? 
-এত মানে মানে করার কি আছে? আঁতেল নাকি কান ঠোসা? 
শেষ কথাটা শুনে কিঞ্চিৎ ধাক্কার মত খেল প্রভাত, ফাহিমের শব্দ প্রয়োগের স্পষ্টতা কানে জ্বালা ধরিয়ে জানান দিল, ফাহিম সত্যি সিরিয়াস। তাচ্ছিল্য ভাব মুখে এনে প্রভাত ভাবছে, ঈশ বললেই হল, মগের মুল্লুক নাকি? গোটা চার বছরের ভিত্তি নিয়ে দণ্ডায়মান সম্পর্কটা তালাকের মত একটা শব্দ দিয়ে ছিন্ন করার অন্তত মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য কারণ তো থাকা চাই। আজ সন্ধ্যায় দুজনে এক সাথে সময় কাটিয়ে ছিল। তখন ফাহিমের অবস্থা ছিল দীঘির জলের ঠাণ্ডা পানির মত শান্ত, হুট করেই সতর্কীকরণ বা কোন পূর্বাভাস না দিয়েই তেলে বেগুনে জ্বলে, একেবারে হাই কোট দেখিয়ে দিবে? নিজের ভিতরে গর্জে উঠা বিষণ্ণতা আর প্রেম হারানোর বেদনা বুকে চেপে প্রভাত খুব স্থির ভাবে ফাহিমকে পুনরায় প্রশ্ন করল, 
-তুমি কি বলতে চাচ্ছ? 
-একবার বলেছি, আর রিপিট করতে পারবো না। এখন ফোনটা রেখে আমাকে উদ্ধার কর সোনা। 
-সত্যি তুমি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও না? 
-আর কত বার বলব, ধ্যাত ...। 

ধ্যাত বলেই ফাহিম ফোনটা কেটে দিল, এ দিকে সমান তালে প্রভাত ফাহিমকে ফোনে ধরতে চেষ্টা করছে। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। টেক্সট ম্যাসেজ দিয়ে বার বার একটা প্রশ্নই করে যাচ্ছে, “আমার ভুলটা কোথায় সেইটা তো অন্তত বল” খানিকক্ষণ পর দেখল মোবাইল অফ। রাত তিনটে নাগাদ যত বারই ফোন করেছে প্রভাত, একটা হতচ্ছাড়ি মেয়ে দুনিয়ার বাজে কণ্ঠ নিয়ে বার বার ঐ একই কথা বলছে, “দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুণ” প্রভাতের বিষণ্ণতা আর রাগ গিয়ে পড়ল ঐ মোবাইল কোম্পানির বিস্রি কণ্ঠের অধিকারিণী মেয়েটা না মেয়ে নয় মহিলাটার উপর। আচ্ছা করে একটা মাঝারী মাত্রার ভূমিকম্পের আগাত খেল বেচারা হাতের মোবাইলটা। প্রভাত মন খারাপ করে বসে আছে বারান্দায়। তার নিজস্ব পরিচর্যায় বেড়ে উঠা দুটো বেলি ফুলের টব ঝুলছে। শীতের কনকনে ঠাণ্ডা তার উপর দক্ষিণা হাওয়া এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে সদ্য ফোঁটা বেলি ফুলের ঘ্রাণ। অন্যদিন হলে নাক, মুখ, চোখ সব নিয়ে উপুড় হয়ে বেলিফুলের সুভাষে নিজেকে ভাসিয়ে দিত প্রভাত। কিন্তু আজকের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য সবচেয়ে পছন্দের বেলিফুল ও তার কাছে অসুন্দর লাগছে। স্মৃতির ক্যানভাস খুলে চার বছর আগে চলে যায় প্রভাত।

সরকারী ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর ও প্রভাত ভর্তি হল দেশের নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। বাবার অগাধ টাকা থাকলে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নাকি আজকাল ফ্যাশনের আওতা ভুক্ত। ইউনিভার্সিটি লাইফের প্রথম দিনেই প্রভাত একজনের উপর ক্যাশ খেল। ক্লাসমেটদের চোখের আড়ালে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে চুকিয়ে নিজের ভীতরে লালন করতে থাকে সেই মানুষটাকে। ভয় কিংবা ভালোবাসা প্রত্যাখ্যানের দ্বিধা দ্বন্দ্বে কাটল প্রভাতের প্রথম সেমিস্টার। ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসের সামনে দাঁড়ীয়ে কম করে হলে ও হাজার বার প্রশ্ন করেছে নিজেকে, প্রেমে পড়বি ভালো কথা, তাই বলে নিজের বিজনেস কমিউনিকেশনের টিচার!! আর টিচার টা ও যা ইচ্ছে তাই, বলি তুমি টিচার মানুষ, বয়স কম করে হলে ও ৩৫ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে কোথায় বিয়েথা করে বউ বাচ্চা নিয়ে মায় মুরব্বীর আসনের দিকে অগ্রসর হবে তা না, জিম করে শরীর বানিয়ে রেখেছ সোহাগ নিগারের মত, ৫.১১” উচ্চতা নিয়ে সেজেছ কাঞ্চন লংকা আর উপরওয়ালার কাছ থেকে উপরি হিসাবে পেয়েছ দুধে আলতা গাত্র বর্ণ। সব মিলিয়ে একে বারে রূপে গুণে ১৬ আনা পরিপূর্ণ। এত কিছুর অধিকারী হয়ে ন্যারো প্যান্ট আর টাইট ফিটিং শার্ট পরে চোখের সামনে হন হন করে ঘুরে বেড়ালে, আমাদের মত সমকামী যুবকদের প্রেমে না পড়ে কি বা করার থাকে?

নিজের সাথে প্রতিদিন আজে বাজে বকে, মনের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে, প্রভাত প্রত্যাশা করত তার উপর ফাহিম স্যারের দৃষ্টি। আর ফাহিম স্যার তার মনের কথা বুঝে হোক কিংবা নিজের মনের চাহিদার খোরাক মিটাতে হোক, কোন দিন ও প্রভাতকে নিরাশ করেনি। আড়ালে আবডালে স্যারের আর নিজের দৃষ্টি যখন সরাসরি সংঘর্ষ বেঁধে যেত, তখন প্রভাতের সেই দৃষ্টি বেধ করে ঠিক বুকের মাঝখানটাই গিয়ে লাগতো। বোধহয় স্যারের বেলাতে ও একই ব্যাপার ঘটত। তাই তো একদিন ক্লাস শেষে একটা চিরকুট লিখে প্রভাতের পায়ের নিচে ফেলে বেড়িয়ে গেল ফাহিম স্যার। চিরকুটখানি হাতে নিয়ে ব্যাঙের মত লাফিয়ে উঠল প্রভাতের হৃদয়। বেশী কিছু ছিল না ঐ কাগজের টুকরোয়, মোটে একটা লাইন। “বেলা তিনটের দিকে গেইটের সামনে থাকবে”

কাঁধে শাহরুখ খানের ম্যায় হু না টাইপের ব্যাগ ঝুলিয়ে সম্ভাব্য প্রেমের প্রত্যাশী প্রভাত নিজেকে শাহরুখ না ভাবলে ও প্রেমিক পুরুষ রহিম মিয়া মনে করছে। সামনে তাকাতেই ফাহিম স্যারের গাড়ীর হর্ন। নিজে ঝুঁকে এসে গাড়ীর দরজা খুলে প্রভাতকে চোখের ইশারায় গাড়ীতে উঠার আহ্বান। প্রভাত কাল বিলম্ব না করে বাধ্য ছেলের মত নিজেদের গাড়ি পার্কিং এ রেখে স্যারের সাথে রওয়ানা দিল। এক টানে গাড়ী থামল ধানমণ্ডির লেকের জাহাজ বাড়ীর পাশে। পথের মধ্যে দুজনের কেউ শব্দ বিনিময় করেনি। ফাহিম স্যার গাড়ী থেকে নেমে লেকের দিকে হাঁটতে লাগল, প্রভাত ও তার পিছু পিছু। কিছুদূর গিয়ে স্যার ঘুরে দাঁড়াল প্রভাতের দিকে, স্যার কোন জড়তা কিংবা ভণিতার আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি বলে, 
-এই ছেলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার চোখের ভাষা যদি পড়তে ভুল না করি তাহলে তুমি ও আমাকে ভালবাস। যদি ও আমি তোমার নামটা পর্যন্ত জানি না। এনিওয়ে, আমি এখন লেক থেকে বেড়িয়ে যাব, তুমি যদি আমায় ভালবাস তাহলে গাড়ীতে গিয়ে বসবে ২ মিনিটের মধ্যে। 
স্যার কথা গুলো বলেই সোজা হাটা ধরল গাড়ীর দিকে। প্রভাত তখনো ওখানেই ঠায় দাঁড়ীয়ে রইল, আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত ভালবাসা বাস্তবিক রূপে! উল্টো তাকে যেচে এসে প্রস্তাব দিবে, এতটা আশা করতে পারেনি প্রভাত। মিনিট খানিকের মত চিন্তা ভাবনা করে গাড়ীর দিকে দৌড়াতে লাগল প্রভাত। দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখে ফাহিম স্যার মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে। প্রভাত গাড়ীতে বসতে বসতে বলল, 
-আমি প্রভাত। 
-মোবাইল নাম্বার বল।
-০১৭১২......। 
নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করে গাড়ীর পিছনের সিট থেকে একটা গিফটের প্যাকেট তুলে প্রভাতের দিকে মেলে ধরল ফাহিম স্যার। প্রভাত হাত কাঁপাতে কাঁপতে গিফট হাতে নিয়ে ডরে ভয়ে স্যারের দিকে তাকাল। স্যার প্রভাতের মুখটা দুহাতে চেপে ধরে আলতো করে একটা কিস খেয়ে গাড়ী স্টার্ট দিল। সাথে রিমোট টিপে ছেড়ে দিল ক্রিস্টিনার “Thousand year” I have died every day waiting for you Darlin' don't be afraid I have loved you for a Thousand years I'll love you for a Thousand more…. 

প্রভাতের গানের দিকে কোন মন নেই। লুকিং গ্লাসে স্যারের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, তার স্বপ্নের পুরুষ বিনা নিমন্ত্রণে এইভাবে তার কাছে ধরা দিবে স্বপ্নে ও ভাবেনি। সাথে এইটা ও বুঝতে পারল স্যার কিছুটা অদ্ভুত। এই ভাবে দু চারটে বাক্য ব্যয় না করেই সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব, পৃথিবীতে ঐটাই বোধহয় প্রথম। এই ধরণের মানুষ গুলো অতিরিক্ত বাস্তববাদী হয়। নাটকীয়তার ধারে কাছে পা মাড়ানো এদের স্বভাবের বাহীরে। এরা অন্যকে চমকে দিয়ে দ্বিধায় দ্বন্দ্বে রাখতে পছন্দ করে। সেই থেকে তাদের সম্পর্কের সূচনা। সাবলীল দৃষ্টিতে একটা হ্যাপি সম্পর্ক নির্দ্বিধায় বলা যায়। কোন দিন খুব বেশী জগরা হয়েছে বলে ও প্রভাতের মনে পড়ে না। এই একটু আধটু মান অভিমান মাঝে সাঁঝে হয়েছে বটে, সেইটা সব সম্পর্কেই থাকে। মানঅভিমান না থাকলে সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত হয় না। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সে মানতে পারছে না। তার কোন দোষ হলে সে অকপটে সেইটা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত। তাই বলে সরাসরি সম্পর্ক শেষ বলে মুখ মুছে ফেলার অংক সে মেলাতে পারছে না কিছুতেই। তার মানে ফাহিম তার জীবনে ঝড়ের মতে এসে হাওয়ার মত মিলিয়ে যাবে? নাহ তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। নিশ্চয় ফাহিম তার সাথে রসিকতা করছে। কাল সকালে হয়তো সে আবার কল দিয়ে বলবে, -কেমন চমকে দিলাম হা? প্রভাত বসা থেকে উঠে ওয়্যার ড্রপ খুলে পুরনো একটা মোবাইল খুঁজে বের করল। রাগের চটে আছাড় দিয়ে ভাঙা মোবাইল থেকে সিম বের করে পুরাণ মোবাইলে লাগাল। 

প্রভাতের আশায় গুঁড়ে বালি। সাত দিনে ও ফাহিম কল করল না। প্রভাত ইচ্ছে করেই ইউনিভার্সিটিতে যায়নি। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট প্রভাত গত সাত দিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। কাছের কোন মানুষ মারা গেলে ও বোধহয় সে এতটা চোখের জল ফেলত না। সাত দিন যেহেতু ফাহিম তাকে ফোন করেনি তার মানে ফাহিম মিন ইট। ৮ দিনের মাথায় রাত দেড়টার দিকে ফাহিম গাড়ী নিয়ে রাস্তায় নামে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। গাড়ীটা লেকের পাশে জাহাজ বাড়ীটার সামনে ফেলে বসে আছে সে লেক ঘেঁষে। সিগারেট একটার আগুন দিয়ে একটা ধরাচ্ছে সাথে চিন্তার রেল গাড়ী ও চলছে। একটুপর কে যেন তার কাঁধে হাত রাখল। সে পিছন ফিরে আবছা আলোয় দেখতে পেল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে। প্রভাত কিছু বলার আগেই ফাহিম বলতে লাগল, 
-প্রভাত অ্যাই এম সরি। 
-সরি মানে? 
-আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম আমি বাই বলার পর ও তুমি আমাকে ভালবাস কিনা? 
-কি দেখলে? 
-গত সাত দিন ধরে তোমার পিছনে স্পাই লাগিয়ে খবর নিয়েছি। আমাকে হারিয়ে একটি রাত ও তুমি শান্তিতে ঘুমাতে পারোনি। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে নিজেকে গৃহ বন্ধী করে রেখেছিলে তুমি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি ও তোমাকে অনেক মিস করেছি। আর এই সাত দিনে বুঝতে পেরেছি তুমি আমার ভিতরে কতটা স্থান জুড়ে অবস্থান করছ। অবশ্যই আমার যে বয়স এই বয়সে এই ধরনের পাগলামি যায় না। তারপর ও করেছি, কারণ তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আমি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি U.S.A তে। আমি চাই তুমি ও আমার সাথে যাবে। এই দেশে থেকে আমার এই সম্পর্কের কোন নাম দিতে পারব না কোন দিন। তাই আমার উদ্দেশ্য ওখানে গিয়ে বিয়ে করব আমরা। যাকে নিয়ে সারা জীবন কাটানোর ইচ্ছা আমার, তার ভিতরটা আরও একবার জ্বালাই করে দেখার ইচ্ছে ছিল বিধায় এই পাগলামির আশ্রয় নিলাম। এখন তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব। কারণ আমার তোমার অপরাধী। 
-তোমার কথা শেষ? 
-হা। এখন তুমি বলতে পারো।

প্রভাত কিছুক্ষণ সময় আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে শুরু করল, 
-ফাহিম তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়। বাস্তব দুনিয়া সম্পর্কে আমার চেয়ে তোমার ধারনা অধিক। অকপটে স্বীকার করছি আমি, কিন্তু তোমার এই পাগলামি, ছেলে মানুষী হিসাবে নিতে পারছি না বলে দুঃখিত। বলেছিলে তুমি এই কয়দিন আমার উপর স্পাই লাগিয়ে খবর নিয়েছিলে, সত্যি কি তাই? পেরেছিলে খবর নিতে আমার ভিতরে কি ঝড় তুলেছিলে তুমি? প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে কাটিয়েছি দিনগুলি। সারা মন প্রাণ চিন্তা চেতনা জুড়ে ছিলে তুমি আর তোমার ভালোবাসার প্রতি আমার অবিশ্বাস এবং সন্দেহের বীজ। একটু চিৎকার করে কাঁদতে পারলে ভালো হত, কিন্তু সেটাও পারিনি। নিজেকে অচেনা লেগেছে বারংবার, মনে মনে বলি, আজো আমি মানুষ চিনতে ভুল করি কি করে? আজো কেন বোকার মত মানুষকে বিশ্বাস করি আর যথারীতি ঠকি, এত কিছুর পর ও আমার বোধ হয় না! বার বার ভুল করে জীবন থেকে কিছুই শিখিনী আমি। এই যে দেখ এত কষ্ট তোমার কাছ থেকে পাওয়ার পর ও তোমাকে একটুর জন্য ও ভুলতে পারিনি। তাই তো চার বছরের আগে সেই যায়গায় এসে বসেছি, যেখানে প্রথম বলেছিলে ভালোবাসি। তোমার পাগলামি কিংবা ছেলেমানুষি তোমারই থাক, আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে সেই কষ্টের সাথেই নাহয় হোক আমার বাকি জীবনের পরম বন্ধুত্ব। কিন্তু তোমাকে কাছে টেনে পুনরায় কষ্টের সাগরে তরী ডুবানোর কোন ইচ্ছা আমার নাই। ভালো থেকো।

প্রভাত কথা গুলো বলেই বসা থেকে উঠে হাঁটা ধরল। এক বার ও পিছনে ফিরে তাকায়নি ফাহিমের দিকে। ফাহিমের বোধহয় আরও কিছু বলার ছিল। প্রভাত লক্ষ্য করেছে ফাহিম তার পিছন পিছন আসছে। প্রভাত গাড়ীতে উঠে সোজা দিল এক টান। লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখল ফাহিম ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় ফিরে নিজেকে অনেক হালকা মনে হল প্রভাতের। নিজের ভীতরে ছাপা যন্ত্রণার বুলি গুলো ফাহিমের মুখের উপরে ছুঁড়ে মারায় মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। তার নিজের ভাবতে কষ্ট হচ্ছে ভালোবাসা কি নদীর তীরে বালুর তৈরি খেলনা ঘর? ইচ্ছে হল যত্ন করে বানালাম ইচ্ছে হল ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আর ইচ্ছে হলে ভালবাসার সাথে তামাশা শুরু করলাম। যে কোন সম্পর্ক টিকে থাকে বিশ্বাসের উপর, আর প্রভাত ভাবছে যাকে সে এতটা বিশ্বাস করে সে অবিশ্বাসের সুরে পুতুল খেলার মত পরীক্ষা নেয়। গুল্লি মারি তার এমন ভালোবাসার।

দুইদিন পার হয়ে গেল, প্রভাত আগের মতই আছে, একটুর জন্য ও ভুলতে পারেনি ফাহিমকে। তার ঘরের আসবাব পত্রের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে ফাহিম তার ভীতরে। অনেক চেষ্টা করে ও তাকে বিন্দু মাত্র ঘৃণা উপহার দিতে পারল না প্রভাত। গৃহ বন্ধী হয়ে নিজেকে আটকে রেখেছে আরও কিছুদিন। কিন্তু যে কপাল সেই মাথা। ফাহিমকে সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। দিন দশেক পরের কথা। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সে ফোন দিল ফাহিমের মোবাইলে, এক রিং হতেই ওপাশ থেকে ফাহিমের উত্তর, 
-হ্যালো 
-কেমন ছিলে? 
-তুমি যেমন ছিলে। 
-আমি তো দিব্যি ভালো ছিলাম। 
-তাই? 
-হু 
-তুমি মটেও ভালো ছিলে না প্রভাত। তুমি আমাকে আগের চেয়ে বেশী মিস করেছ। যদি ভুল না করি আগের চেয়ে আরও বেশী আমার প্রতি ভালোবাসায় পড়েছ। এই কয়দিন তুমি যে দিকে তাকাতে আমার অবস্থান উপলব্ধি করতে। 
কান্না জোরানো কণ্ঠে প্রভাত বলল, -কি করে বুঝলে? 
-কারণ একই ফিলিংস আমার হয়েছে তোমার জন্য। আমি আমার নিজের ভালোবাসা দিয়ে তোমার ভিতরে অবস্থান করেছি যেমনটি তুমি করছ আমার মাঝে। প্রভাত মানুষই তো ভুল করে আমি ও করেছি। তবে ব্যাপারটা যে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে আগে ভেবে দেখিনি। ইচ্ছে ছিল তোমার রাগ ভাঙিয়ে বলবো চল বাহিরে চলে যাই, আমাদের ছোট ছোট দুঃখ আর সুখ গুলো দিয়ে সাজিয়ে তুলি ভালবাসার সংসার। 
-অফারটা কি ষ্টীল স্ট্যান্ড? 
-সারা জীবন এই অফার তোমার জন্য থাকবে প্রভাত। 
-ফাহিম আমি সত্যি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। 
-আমি জানি প্রভাত। আমি ও তোমাকে...। 
-তাহলে আমার সাথে এখন দেখা করতে পারবে? 
-এখন রাত বাজে ১১.৩০ কোথায় দেখা করবে? 
-হোক রাত। এমন রাতই বা কটা আসে জীবনে? কত দিন তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি, খুব ইচ্ছে করছে ঝাঁপিয়ে পড়ি তোমার বুকে। কি আসবে না? 
-আমি কি তোমার কথা ফেলতে পারি? কোথায় দেখা করবে? 
-যেখানে তোমার সাথে প্রথম ভালোবাসা বিনিময়, যেখানে আবার শেষ হয়েছে, সেইখান থেকে আবার শুরু করতে চাই। 
-ওকে আমি আসছি। 



প্রভাত পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হল, একটু শব্দ পেলে তার বাবা ঘুম থেকে জেগে যাবে। বাবা জাহাজের ক্যাপ্টেইন আজ এ দেশে তো কাল অন্য দেশে। ছোট বেলেতে মা বাবার ছাড়া ছাড়ি হয়ে যায়। সে বাবার একলা বাড়ীতে থাকতেই বেশী পছন্দ করে। গ্যারেজ থেকে গাড়ী নিয়ে রাস্তায় নামল প্রভাত। যদি তার বাবা বাড়ী না থাকত তাহলে ফাহিমকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসত, এ দিকে ফাহিমের বাসায় গিয়ে ও থাকার জো নেই। খুবই রক্ষণশীল পরিবার তার। দিনে বন্ধুবান্ধব গেলেই তার মায়ের হাজারটা প্রশ্ন তাই রাতে ও মুখো হবার প্রশ্নই উঠে না। হাতের ঘড়ী দেখল ১২টা বাজার ১৫ মিনিট বাকি। সে ভাবতে লাগল অনেক দিন পরে ভালোবাসার মানুষটাকে আবার কাছে পাচ্ছে, তার পছন্দের কিছু অর্কিড গিফট করলে সে নিশ্চয় আরও বেশী খুশি হবে। যে কথা সেই কাজ, গাড়ী ঘুরিয়ে শাহবাগের দিকে ছুটল প্রভাত। তড়িঘড়ি করে কিছু মিক্সড কালার অর্কিড তুলে নিলো। এর মাঝে ফোনে দুবার কথা হল ফাহিমের সাথে। ফুল গুলো নিজের পায়ের উপরে রেখে গাড়ী ড্রাইভ করছে সে, আর ভাবছে ভবিষ্যতে দিন গুলোর কথা। সে সত্যি অনেক লাকি। কথাটা ভাবতেই তার গাড়ী মোড় নেয় বাটা সিগন্যাল ধরে, সাইন্স ল্যাব পার হচ্ছে এমন সময় অন্য একটা কার তার গাড়ী সামনে এসে পড়ে। অসতর্ক থাকায় সে ব্রেক করতে পারেনি। প্রভাতের গাড়ী অন্য গাড়ীটার ভীতরে ঢুকে গেল।

প্রভাত এখন স্কয়ার হসপিটালে। ১৭ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরেছে তার। একজন নার্স তার নাম ধরে ডাকা ডাকি করছে। প্রভাত চিন্তা করতে লাগল কাল রাতের ঘটনা। তার সমস্ত শরীর সাদা কাপড়ে ব্যান্ডেজ করা। হাত নাড়াতে পারছে না। তারপর ও নার্সকে ডেকে বলল, তার মোবাইল ফোন কোথায়, নার্স বলল আপনার জিনিষ পত্র সব আপনার বাবার কাছে। প্রভাত নার্সকে অনুরোধ করল তাকে একটা মোবাইলের ব্যবস্থা করে দিতে। নার্স বলল আই.সি.ইয়ু তে মোবাইল ব্যাবহার করা নিষেধ। সে অনেক অণুয় বিনয় করল একটা মোবাইলে এক মিনিট কথা বলার জন্য। নার্স উল্টো তাকে অক্সিজেনর মাস্ক পরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নার্স জানে প্রভাত কাকে কল করতে চায়। যাকে কল করার জন্য সে এত অস্থির সে আর কোন দিন তার কল রিসিভ করতে পারবে না। নাফেরার দেশে সে পাড়ি জমিয়েছে। সকালে ফাহিমের লাশ একই হসপিটালের মর্গ থেকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। 

প্রভাত হয়তো জানত না সে নিজের হাতেই নিজের ভালোবাসাকে গাড়ি চাপা দিয়েছে। হয়তো ঐটাই ছিল তাদের অবধারিত নিয়তি। মানুষ জানে না কাল সকালের সূর্যোদয় দেখতে পারবে কিনা। অজানা ভবিষ্যতের কথা মোবাইলের টু ডু লিস্টে লিপিবদ্ধ থাকে না। আর জীবন মানুষকে সুখে থাকার জন্য খুব বেশী সুযোগ দেয় না। তাই অবিশ্বাস, জগরা-ঝাঁটি, মান-অভিমান দিয়ে জীবনের সুখময় মুহূর্ত গুলো দুঃখে পরিণীত করার কোন মানে হয় না।

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?