অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের সুখ-দুঃখ আর ভবিষ্যতের একরাশ স্বপ্ন ও প্রত্যাশা...
এই নিয়েই আমাদের জীবন।
তার মধ্যে ভবিষ্যৎ টাই আমাদের জন্য অনিশ্চিত।
আমরা এর জন্য শুধু কামনা আর চেষ্টাই করতে পারি। কিন্তু পারিনা পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে।
যদি পারতাম ! তাহলে আমাদের অতীতটা শুধু সুখময় স্মৃতির, আর বর্তমানে দুঃখের কোন উপস্থিতিই থাকত না।
তার পরেও মানব মনের অন্তরাল থেকে স্বপ্নের জাল বোনার কাজটাকে তো কেউ থামাতে পারেনি, পারবেও না। কিছু সিদ্ধান্ত আমরা আমাদের বর্তমানে নেই, যা অনেক সময় আমাদের হাজারো স্বপ্নে ঘেরা ভবিষ্যতকে এক জ্বালাময় অতীতের রূপ দেয়। আর তখন হাজার চাইলেও সেই ভুলকে সংশোধন করার ক্ষমতা আমাদের থাকেনা...
আমি অলক...
নেদারল্যান্ডের একটা LGBT সংস্থার হয়ে কাজ করছি গত বছর তিনেক যাবত।
যেহেতু এখানে সমকামীদের অধিকার ও ভালবাসার ক্ষেত্রে তেমন কোন বাধা নিষেধ নেই ।
তাই এখানে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে প্রায় শ’খানেক LGBT সংস্থা। যাদের প্রধান কাজ সমকামী, উভকামী ও ট্রান্সজেন্ডার দের মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক ভাবে সচেতন ও সাহায্য সহযোগিতা করা। আমিও এমনি একটি সংস্থার সাথেই জড়িত।
গত তিন বছরে বিভিন্ন জাতির কয়েক হাজার সমকামী ছেলে ও মেয়েকে দেখেছি।
তাদের সাথে কথা বলেছি।
তাদেরকে নানা ভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। আর এদের মাঝে একটি জুটি... আমার সবচেয়ে প্রিয় ও সবচেয়ে স্পেশাল... নিলয় – স্বপন।
নাম শুনেই বুঝতে পারছেন যে তারা বাঙালি।
হ্যাঁ , আর এটাই ছিল আমার তাদের এত ভাল লাগার প্রধান কারন।
আর তারাই আমাদের সংস্থার সাথে সপৃক্ত একমাত্র বাঙালি জুটি।
আমি নিজে এখনো নিজের জন্য কাউকে পাইনি।
তাই ওদের দেখলে আমার মনে হয় যেন ওদের মাঝে আমি নিজেকে খুজে পাই।
ওদেরকে জানি প্রায় বছর খানেক হয়।
আর এতদিনে ওদের সাথে সংস্থার বাইরেও খুব ভাল একটা সম্পর্ক হয়ে যায় আমার।
আসলে ওদেরকে আমার নিজের পরিবারেরই একটা অংশ মনে হত।
তাই ওদের খুঁটিনাটি কোন বিষয়ই আমার অজানা ছিলনা।
নিলয় খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। বছর চারেক আগে স্কলারশিপ নিয়ে এখানে আসে।
আর এখানে আসার পর ফেসবুকের কল্যাণে স্বপনের সাথে পরিচয় হয় ওর।
স্বপন মফস্বলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে।
ছোট বেলায় মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়।
আর স্বপন তার চাচার ঘরে মানুষ হতে থাকে।
কিন্তু চাচার বড় সংসার আর সল্প আয়ের পরিবারে স্বপন অনেক অবহেলায়ই বড় হয়।
নিজেকে সব সময় একাই ভাবতে থাকে সে।
আর খুজে বেড়িয়েছে এমন কাউকে যাকে সে নিজের আপনজন বলে দাবী করতে পারে।
আর অদৃষ্টের ইশারায় একদিন নিলয়ের সাথে পরিচয় হয় তার।
আর অল্পদিনেই তাদের মাঝে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
পরে একসময় তাদের বন্ধুত্ব ভালবাসায় রূপ নেয়... তাদের ভালবাসা ফেসবুকের বেড়ী পেরিয়ে, ফোনালাপ, স্কাইপ ইত্যাদিতে গিয়ে পৌছায়।
কিন্তু তাদের সম্পর্কের মাঝে যেন কালের বাধা হয়ে দাড়ায় তাদের দূরত্ব।
আর এই বাধাটি ভাঙার উদ্যোগটা নিলয়ই নেয়।
নেদারল্যান্ডের কিছু বন্ধুর সহায়তা নিয়ে একসময় সে স্বপনকে তার কাছে নিয়ে আসে।
আর এখানে আসার পরেই দুজন সামনা সামনি দাড়িয়ে একে অপরকে নয়... তাদের অপার ভালবাসার সার্থকতাকে দেখছিল।
অবশেষে স্বপন খুজে পেয়েছিল তার আপনজনকে।
যাকে নিয়ে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে।
অপরদিকে নিলয়ও তার বহুকাল জিয়িয়ে রাখা ভালবাসাকে কারো নামে উৎসর্গ করার আনন্দে আত্বহারা। ভালই কাটছিল তাদের ভালবাসার ছোট্ট সংসার।
কিছুদিনের মধ্যেই স্বপন একটা চাকরির যোগাড় করে ফেলল।
আর তার পরে তাদের সংসার আরো একটু বেশি সমৃদ্ধ হল।
সকাল বেলা দু’জোড়া ঠোটের উষ্ণ ছোয়ায় ঘুম থেকে ওঠা।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাত ব্রাশ করার সময় থুতনিতে গুঁতো দিয়ে একে অপরকে হাসানো।
বাথটাবে দুজন দুজকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে মাথা ডুবিয়ে রাখা।
সকালের নাস্তা একে অপরের হাতে খাওয়া।
লাঞ্চ টাইম আলাদা আলাদা হওয়ায় একজন না খেয়ে বসে থেকে একসাথে খাওয়া শুরু করা।
আর খাওয়ার পুরো সময়টুকু ফোনালাপে একে অপরের সাথে মগ্ন থাকা।
কাজ শেষে বাসায় ফিরে স্বপনের রান্না করে নিলয়ের পথ চেয়ে থাকা।
দুজনে এক চাদরের নিচে শুয়ে কাল হো না হো , ভীর জারা বার বার দেখা।
তখন স্বপনের অশ্রুসজল চোখ দুটো মুছে দিয়ে তাতে আলতো করে চুমু খেতে কখনো ভুলেনি নিলয়। বিনিময়ে নিলয়ের বুকের দুর্বা ঘাসবনে নিজের মাথাটি গুজে দিতেও ভুল করেনি স্বপন।
তার পর দুটি টগবগে যৌবনদীপ্ত মানবের সবটুকু ভালবাসার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে একটি নতুন দিনের পথে এগিয়ে যাওয়া... এই ছিল ওদের দৈনন্দিন কার্যলিপি।
আর তার পরেই ঘটনা চক্রে আমি তাদের ছুটির দিনের মেহমান হয়ে গেলাম।
ভালই লাগত যখন ওরা দুজন তাদের ভালবাসার গল্প আমাকে শোনাত।
মনে মনে ভাবতাম কতটা ভাগ্যবান হলে কারো জীবনে এমন সুখ থাকতে পারে।
জীবনে অনেক সমপ্রেমীর জীবনে মিলনের সেতুবন্ধন হয়েছি আমি।
কিন্তু কখনো কারো ভালবাসাকে এতটা কাছ থেকে দেখিনি।
ওদের ভালবাসা দেখে নিজেকে ওদের মাঝেই পরিপূর্ণ মনে হত।
আর এই লোভেই বার বার ছুটে যেতাম ওদের ভালবাসার দ্বারে।
কখনো কখনো ওদের মাঝে ছোট ছোট কিছু বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলে, আমাকেই বিচারক হিসেবে মানত তারা।
আর সমাধানের পর ওদের মুখ দেখলে আমার নিজেরই সন্দেহ হত, আসলেই কি ওদের মাঝে ঝগড়া হয়েছিল!!
সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল পানির স্রোতের মত।
আর নিলয়-স্বপন ও ওদের ভালবাসার পানসি নায়ের দাড় টেনে যাচ্ছিল।
হঠাৎ তাদের সামনে বিশাল এক ঘূর্ণিঝড় হয়ে দেখা দিল তাদের নিয়তি।
তাদের স্বপ্নের ভবিষ্যতকে হতাশার কালো মেঘে ঢেকে দিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল নিলয়ের শিকড়... তার মা বাবা।
তারা নিলয়কে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে লাগল।
নিলয় তাদের একমাত্র সন্তান।
তাই নিলয়কে দেশে ফিরে গিয়ে বিয়ে করে সংসারী হবার জন্য নানা ভাবে বল প্রয়োগ করতে লাগল তারা। প্রথমে কিছুদিন তাদের বাহানা বানিয়ে রাখলেও এক সময় তাদের জেদের সামনে নিলয়ের চেষ্টা দুর্বল হতে লাগল।
আর এদিকে যেন বাগানের সেরা ফুল দুটি মলিন হয়ে যেতে লাগল।
স্বপনের এতটা আপন বলতে যেহেতু কেউ নেই তাই সে কারো ধার ধারে না।
নিলয়ের সাথে ইহজীবন কাটাতে সে সর্বাগ্রে প্রস্তুত।
কিন্তু নিলয় তার মা বাবাকে ছাড়তে পারবে না।
আর তাই সে পড়ল অনেক বড় এক দোটানায়।
এক দিকে তার ভালবাসা... অন্য দিকে বাস্তবতা... সে কোনটাই হারাতে চায়না।
কিন্তু সেকি আর হয় বটে... একটাকে পেতে হলে অন্যটাকে যে বিসর্জন দিতেই হবে।
ওরা যখন ব্যাপারটা আমাকে জানাল, তখন আমিও বাকশূন্য হয়ে গেলাম।
জানি এখানে বাকশূন্য হওয়া আমার সাজে না।
কারন এমন অনেকের সমস্যার সমাধান আমি করেছি।
কিন্তু তাদের ব্যাপার টা অন্য রকম ছিল।
কারন তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি আমাদের চেয়ে অনেক অনেক আলাদা।
তাই আমি এখানে কি জবাব দেব বুঝিনি।
আমি হয়ত পারতাম তাদের সব কিছু উপেক্ষা করে ভালবাসার পক্ষে থাকতে।
কিন্তু আমার বিবেক আমাকে বাধা দিচ্ছিল।
কারন যতই হোক বাবা মায়ের অবজ্ঞা করার বুদ্ধি আমি কাউকে দিতে পারিনা। আবার এদিকে মা বাবার কথা মানতে বললে একটা নিস্পাপ ভালবাসাকে গলা টিপে হত্যা করা হবে।
যা করতে আমার মন আমাকে বাধা দিচ্ছিল।
আর এ নিয়ে আমার মন আর বিবেকের মধ্যেই দ্বন্দের সৃষ্টি হল।
তাই মন আর বিবেকের মাঝে মধ্যস্ততা করতে আমারে নীরবই থাকতে হল...
এভাবে কিছুদিন চলতে থাকল।
এরই মধ্যে আমি দুটি নিস্পাপ ফুলের ঝড়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলাম।
আর এদিকে আমার নীরবতা নিলয় স্বপনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল আমার অপরাগতা।
হঠাৎ একদিন ওরা আমাদের সংস্থার চেয়ারম্যান ডঃ ফেন্সিন হ্যানরিকের সাথে দেখা করতে চাইল।
এ কথা শুনে আমার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেল।
মনে হল আমার শরীরে ১১০০ ভোল্টের বিদ্যুতের শক লাগল।
ফেন্সিনকে আমার চেয়ে ভাল আর কে চেনে।
সে এ পর্যন্ত অনেকেরই এমন সমস্যার সমাধান করেছে।
কিন্তু তার দেয়া বুদ্ধিতে এ পর্যন্ত অনেকের সম্পর্ক টিকে গেলেও ধ্বংস হয়েছে অধিকাংশের জীবন।
তাই আমি নিলয় ও স্বপনকে বার বার নিষেধ করলাম ফেন্সিনের সাথে দেখা করতে।
কিন্তু তারা মানতে নারাজ। স্বপন নিলয়কে ছাড়া থাকতে পারবে না।
আর নিলয় স্বপন ও তার পরিবার উভয়কেই চায়।
যেহেতু তারা আমার কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছিল না, তাই তাদের সামনে ফেন্সিন ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।
তারপরের আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম।
কিন্তু হঠাৎ একদিন নিলয় ও স্বপন আমার অগোচরেরই গিয়ে হাজির হল ফেন্সিনের অফিসে।
আর তারপর... যা হবার তাই হল... সব কিছু শোনার পর ফেন্সিন তাদের ভালবাসা ও পরিবার উভয়কে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য স্বপনকে Reassignment surgery (লিঙ্গান্তর) করার করার পরামর্শ দিল।
এতে সে স্ত্রী হয়ে সারা জীবন নিলয়ের সাথে থাকতে পারবে।
ফেন্সিনের রুমের ওই ২০মিনিট ওদের আরো বড় এক ভাবনায় ফেলে দিল।
ফিরে এসে যখন ওরা আমাকে জানালো তখন আমি ওদের অনেক আকুতি মিনতি করে বুঝালাম।
নিলয়ও ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না।
তাই সেও এতে তার অমতের কথা জানালো।
তাই এখন সব কিছু স্বপনের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করল।
কিন্তু স্বপন ফেন্সিনের অফিস থেকে আসার পর থেকেই কেমন জানি স্থবির হয়ে গেল।
তার মুখ থেকে সে একটা শব্দও করছিল না।
মনে হচ্ছিল সে অন্য কোন জগতে হারিয়ে গেছে।
জানিনা সে আমাদের কথা শুনছিল কিনা।
৩ দিন পর হঠাৎ সকাল বেলা নিলয়ের ফোন এল।
সে আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বাসায় যেতে বলল।
বুঝতেই পারছিলাম বড় কোন দুঃসংবাদ শুনতে যাচ্ছি আমি।
তড়িঘড়ি করে গিয়ে পৌছালাম ওদের বাসায়। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার সারা শরীর জমে আসছিল। পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
১০তলার উপরে ওদের ছোট্ট ঘরের বিশাল জানালায় দাড়িয়ে আছে স্বপন।
তার থেকেও প্রায় ১০ গজ দূরে ঘরের মাঝখানে বোবার মত দাড়িয়ে আছে নিলয়।
আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে অবুঝ শিশুর মত কাদতে লাগল নিলয়।
ওকে একটু শান্ত করার পর জানতে পারলাম সকালে ঘুম ভাঙার পর স্বপন নিলয়কে জানায় সে লিঙ্গান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একথা শোনার পর নিলয় রাজি না হলে স্বপন পাগলের মত আচরন করতে থাকে।
এক পর্যায়ে সে জানালার উপরে উঠে পড়ে এবং শর্ত দিয়ে দেয় তার লিঙ্গান্তর করায় রাজি না হলে বা তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করলে সে এখান থেকে লাফ দিবে।
অনেক বুঝানোর পরেও সে না মানলে নিলয় তার মা বাবাকে ত্যাগ করার কথা জানায়।
কিন্তু তাতেও সে রাজি হয়নি।
নিলয়কে শান্তনা দিয়ে আমি স্বপনকে বললাম,
- স্বপন তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? তুমি জানো Sex Reassignment surgery কতটা ভয়ংকর?
- আমি আর কিছু জানতে চাইনা অলক ভাইয়া। হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। কারন আমি নিলয়কে ভালবাসি। আর কতটা ভয়ংকর? কি হবে? বড়জোর মৃত্যু... আর নিলয়কে ছেড়ে আমাকে প্রতিদিন হাজার বার মরতে হবে। তার চেয়ে বরং একবারেই মরা ভাল... আমি অপারেশন করবই...
-স্বপন তুমি বোঝার চেষ্টা কর। নিলয় তোমার জন্য তার পরিবারকে ছাড়তে রাজি হয়েছে। তাহলে আর কি সমস্যা রইল?
-না ভাইয়া এ হতে পারেনা। মা বাবা ছাড়া বেচে থাকা যে কতটা কষ্টের তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে। আর আমি চাইনা আমার জন্য আমার নিলয় সেই কষ্ট ভোগ করুক। তাই এটাই বেস্ট আইডিয়া। এতে আমাদের সবারই মঙ্গল। যদি অপারেশন সাকসেসফুল হয় তাহলে আমরা সারা জীবন সুখে বাস করব। আর যদি আমি মারা যাই তাহলে নিলয় তার মা বাবার ইচ্ছায় বিয়ে করে সবাইকে নিয়ে ভাল থাকবে। তাই আমাকে সার্জারী করাতেই হবে...
আমি আবার নির্বাক হয়ে গেলাম। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলনা।
কি বা বলব, স্বপনের ভালবাসার গভীরতা আর আবেগের কাছে আমার সব যুক্তি ছোট হয়ে যাচ্ছিল...
আর এদিকে নিলয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অঝোরে কাদছিল...
অবশেষে স্বপনের জেদ আর ভালবাসার কাছে আমাদের হার মানতেই হল।
আমরা রাজি হলাম সার্জারীতে।
তখন দুচোখের অশ্রুকে চিরে স্বপনের মুখের হাসিটা দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসটাকে অর্জন করল।
হ্যাঁ দামি ই তো।
নিজের ভালবাসার চেয়ে দামী আর কি হতে পারে এ জগতে?
কিছুদিনের মধ্যেই নেদারল্যান্ডের কিছু বড় বড় LGBT সংস্থার সহায়তায় স্বপনের Reassignment surgery’র প্রস্তুতি শেষ হল।
অপারেশনের দিনও ঠিক হয়ে গেল।
অপারেশনের আগের রাতে শেষ বারের মত নিলয় স্বপনকে তার নিজের রুপে কাছে পেল।
এর পরে সে আর এ স্বপনকে দেখবে না।
তখন তার ভালবাসার রাজকুমার স্বপন তার সামনে রাজকুমারীর রুপে আসবে।
জানিনা ওই রাতটা তাদের কেমন কেটেছিল। আর জানতেও চাইনা।
অপারেশন শুরু হবার আগ মুহূর্তে স্বপন শেষ বারের মত নিজেকে আপন রুপে দেখল।
ছুয়ে দেখল নিজের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
আর শেষ বারের মত বুকে টেনে নিল নিলয়কে। কান্নায় ভেঙ্গে পরছিল নিলয়।
কিন্তু সেই তুলনায় স্বপনকে অনেকটা শক্তই মনে হচ্ছিল।
আসলেই ভালবাসা কখনো কখনো মানুষকে এতটা শক্ত করে তুলে যা ধারনা করা যায়না...
টানা ১৮ ঘণ্টা যাবত পর্যায়ক্রমে চলছিল অপারেশন।
অপারেশনটি কয়েকটা ধাপে হচ্ছিল।
আর প্রতিটা ধাপে তার শরীরের একেকটা অংশের সার্জারী করা হচ্ছিল।
১৮ ঘণ্টা পরে যখন শুনলাম অপারেশন শেষ হয়েছে এবং স্বপন সুস্থ আছে তখন অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশ মোতাবেক ৭২ ঘণ্টার আগে আমরা কেউ স্বপনের সাথে দেখা করতে পারলাম না। এই ৭২ ঘণ্টা নিলয়কে দেখে আমার খুব আফসোস হচ্ছিল।
আসলেই কি কেউ কাউকে এতটা ভালবাসতে পারে এ জগতে!
সত্যি আমার জীবনে অনেক বড় একটা ইতিহাস তৈরি করে দিল এ যুগল...
৭২ ঘণ্টা পরে যখন আমরা স্বপনকে দেখতে গেলাম তখন আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
এ কি দেখছি আমি।
হাসপাতালের বেডে যেখানে স্বপনের থাকার কথা সেখানে শুয়ে আছে অপরুপ সুন্দরী এক যুবতী।
যার সাথে স্বপনের কোন মিল খুজে পাচ্ছিলাম না আমি।
একবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাকে খুব স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবেই সে স্বপনের পাশে গিয়ে বসল।
যেন সে তার আগের স্বপনকেই দেখছে।
আমি কিছুটা অবাক হলাম নিলয়ের আচরনে।
সে স্বপনের পাশে বসে বলল,
-এখন কেমন লাগছে স্বপন?
-আমি স্বপন না! স্বপন তো সেই কবেই মরে গেছে। আমি স্বপ্না। নিলয়ের হবু স্ত্রী।
কথাটি শুনে আমি যেন বোকা বনে গেলাম।
আমি কি এই দুনিয়ায় আছি? এ কি দেখছি আমি।
স্বপন নামের সেই তরতাজা যুবকটির মুহূর্তের মধ্যে স্বপ্না হয়ে যাওয়া।
যেন স্বপন নামের কেউ ছিলই না কখনো।
আসলেই নিত্য নতুন প্রযুক্তির কত খেলাই না দেখা বাকি আছে আমাদের...
স্বপন ওরফে স্বপ্নার পুরোপুরি সুস্থ হতে মাস দুয়েক সময় লাগল।
আর এ সময়টা হাসপাতালে তার সেবায় নিজেকে পুরোপুরি ব্যস্ত করে রেখেছিল নিলয়।
পরে যখন স্বপ্নাকে নিয়ে সে ঘরে ফিরল তখন তাকে দেখে আরো একবার অবাক হতে হল আমাকে। কোমর অব্দি লম্বা চুল।
আর শারীরিক গঠনে এক পরিপুর্ন নারী।
দেখে বোঝার উপায় নেই এই স্বপ্নাই কদিন আগে স্বপন ছিল...
এদিকে নিলয় তার মা বাবাকে জানিয়ে দিল সে এখানে এক অনাথ বাঙালি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে ফেলেছে।
তার মা বাবা এতে কোণ বিরোধিতা করলনা।
তারা নিলয়কে বউ নিয়ে দেশে যেতে বলল।
অতঃপর আমরা নিলয়-স্বপ্নাকে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভকামনার সাথে বিদায় জানালাম।
ওরা চলে গেলেও আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হত।
শুনলাম নিলয়ের মা বাবা স্বপ্নাকে অনেক ধুমধামের সাথেই বরন করে নিয়েছে।
এবং দেশীয় নিয়মে তাদের বিয়ে করানো হয়েছে।
খুব সুখে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে তারা।
এসব শুনে নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছিল।
মনে মনে ভাবালাম যাক শেষ পর্যন্ত আমার প্রিয় জুটির মধুর মিলন হয়েছে...
ভেবে নিজে অনেক শান্তি পাচ্ছিলাম।
নিলয় স্বপ্নার গল্পটা এখানেই শেষ হলে পারত।
কিন্তু আমরা মানুষেরা নিজেদের গল্প যতই নিজেরা লেখার চেষ্টা করিনা কেন, বিধাতা তার লিখন অনেক অগেই লিখে রেখেছেন...
নিলয় স্বপ্নার বিয়ের ১ বছর হয়ে গেছে...
ইদানিং আমিও খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছি তার কারনে অনেকদিন হল নিলয় আর স্বপ্নার খোজ নেওয়া হয়না।
তাছাড়া কয়েক বছর হল দেশে যাইনা।
তাই কিছু দিনের ছুটি নিয়ে দেশে গেলাম।
নিলয়দের ঠিকানাটা জানা ছিল।
তাই ওদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য না জানিয়েই ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
আমাকে দেখে ওরা দুজনেই খুব খুশি হল।
পরে ওদের পরিবারের সবার সাথে পরিচিত হলাম।
তবে আমি বার বার স্বপ্নাকে দেখে খুব অবাক হচ্ছিলাম।
যে মেয়েটি আজ এই পরিবারের সকল আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে রেখেছে সারা পরিবারকে, এই কদিন আগেও তার পরিচয় একটি ছেলে হিসেবেই ছিল।
আর এ সত্য আমরা ৩ টি মানুষ ছাড়া আর কেউ জানেনা।
২দিন ওদের সাথে থাকার পরেই আমি কিছু জিনিস লক্ষ করলাম।
নিলয় আর স্বপ্নার মাঝে একটা অভুতপূর্ন মানসিক পরিবর্তন আমার চোখে পড়ল।
বুঝতে পারছিলাম এমন একটা কিছু আছে যা ওরা দুজনেই আমার কাছে ও পুরো দুনিয়ার কাছে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু কি সে ব্যাপার যা ওরা আমার কাছে গোপন রেখেছে!
ভাল করে লক্ষ করার পর আমার সন্দেহ চরমে গিয়ে পৌছাল...
তাই তাদের দুজনকে গোপনে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। কি সেই গোপনীয়তা।
শুরুতে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে তারা মুখ খুলতে বাধ্য হল।
আর যা শুনলাম তা বলার মত ভাষা আমার জানা নেই।
তবে ওদের মুখের কিছু কথা যা না বলে পারছিনা।
নিলয় বলল, -আমি সমকামী।
কখনো কোন মেয়ের মাঝে সেই সৌন্দর্য আমি খুজে পাইনি যা আমি একটা ছেলের মাঝে পেয়েছি।
আর আমার সারাজীবনের সবটুকু ভালবাসা দিয়েই ভালবেসেছি স্বপনকে। যে ছিল আমার সবকিছু।
কিন্তু ঘটনাক্রমে যখন স্বপন স্বপ্না হয়ে গেল তখন সব মেনে নিয়েছি নিজের ভালবাসার টানে।
ভেবেছি নিজের ভালবাসাকে বাচানোর আর কোন রাস্তা নেই। তাই করলাম। ভালই যাচ্ছিল।
কিন্তু দিন দিন যখন আমার কাছে মানসিক ভাবে অনুভব হতে লাগল যে এ স্বপন নয়।
এ স্বপ্না।
সে একজন মেয়ে...
এতে আমি ধীরে ধীরে ওর প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকি।
আর এখন আমি ওকে আর স্বপন ভাবতে পারিনা।
আমার ভালবাসার মানুষ ভাবতে পারিনা।
কি করব আমি এখন? অ
পরদিকে স্বপ্না বলল, -আমি বুঝতে শেখার পর থেকে এমন কাউকে কাছে পাইনি যাকে নিজের আপনজন বলে দাবী করতে পারি।
জীবনের ২১ বছর একাকিত্বের বোঝা তানার পর আমি নিলয়কে পেলাম।
ও আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে ভালবাসা কি।
আপনজনের ভালবাসা কি।
মায়া মমতা কি।
তাই আমার কাছে নিলয়ই আমার পৃথিবী।
নিলয়ই আমার সব।
তাই আমি আমার ভালবাসার পৃথিবীকে হারিয়ে আবার একা হয়ে চাইনি, আর চাইনি ওকেও ওর আপনজনের থেকে আলাদা করতে।
তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু আজ আমি আমার নিজের সিদ্ধান্তের কাছেই পরাজিত।
নিজের ভুল সংশোধন করার কোন রাস্তা আমার নেই।
আমি এখন কি করব???
ওদের এই প্রশ্ন দুটো আমাকে আবারো নির্বাক করা দিল।
আমার মনে আবারো প্রশ্ন জেগে উঠল, আমি এখন কি জবাব দেব?
জানি এই প্রশ্নেরও কোন জবাব আমার কাছে নেই।
বাকহীন ভাবে সেখান থেকে চলে এলাম।
আর নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।
যে আমি হাজারো মানুষের জীবনকে তাদের ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছি।
সেই আমি আজ আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দুটির জন্য কিছু করতে পারলাম না।
নিজের উপরে ঘৃনা জন্মে গেল।
কাল আমার ফ্লাইট নেদারল্যান্ডে।
কিন্তু আমি আর ফিরে যাবনা।
ফিরে যাবনা আর ওই জীবনে যে জীবনে ভালবাসার মানে শুধু বর্তমান।
নেই কোন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
একটি ভুল সিদ্ধান্ত যেখানে কেড়ে নেয় সবকিছু।
আমি চলে যাব অনেক দূরে।
নিলয় আর স্বপ্নার থেকে অনেক দূরে।
যেখানে গেলে ওদের শেষ পরিনতি আর দেখতে হবেনা আমাকে।
আর দেখতে চাইও না। আমি সইতে পারব না।
থাকুক ওরা আমার জন্যে আমার Unseen Future হয়ে...
এই নিয়েই আমাদের জীবন।
তার মধ্যে ভবিষ্যৎ টাই আমাদের জন্য অনিশ্চিত।
আমরা এর জন্য শুধু কামনা আর চেষ্টাই করতে পারি। কিন্তু পারিনা পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে।
যদি পারতাম ! তাহলে আমাদের অতীতটা শুধু সুখময় স্মৃতির, আর বর্তমানে দুঃখের কোন উপস্থিতিই থাকত না।
তার পরেও মানব মনের অন্তরাল থেকে স্বপ্নের জাল বোনার কাজটাকে তো কেউ থামাতে পারেনি, পারবেও না। কিছু সিদ্ধান্ত আমরা আমাদের বর্তমানে নেই, যা অনেক সময় আমাদের হাজারো স্বপ্নে ঘেরা ভবিষ্যতকে এক জ্বালাময় অতীতের রূপ দেয়। আর তখন হাজার চাইলেও সেই ভুলকে সংশোধন করার ক্ষমতা আমাদের থাকেনা...
আমি অলক...
নেদারল্যান্ডের একটা LGBT সংস্থার হয়ে কাজ করছি গত বছর তিনেক যাবত।
যেহেতু এখানে সমকামীদের অধিকার ও ভালবাসার ক্ষেত্রে তেমন কোন বাধা নিষেধ নেই ।
তাই এখানে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে প্রায় শ’খানেক LGBT সংস্থা। যাদের প্রধান কাজ সমকামী, উভকামী ও ট্রান্সজেন্ডার দের মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক ভাবে সচেতন ও সাহায্য সহযোগিতা করা। আমিও এমনি একটি সংস্থার সাথেই জড়িত।
গত তিন বছরে বিভিন্ন জাতির কয়েক হাজার সমকামী ছেলে ও মেয়েকে দেখেছি।
তাদের সাথে কথা বলেছি।
তাদেরকে নানা ভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। আর এদের মাঝে একটি জুটি... আমার সবচেয়ে প্রিয় ও সবচেয়ে স্পেশাল... নিলয় – স্বপন।
নাম শুনেই বুঝতে পারছেন যে তারা বাঙালি।
হ্যাঁ , আর এটাই ছিল আমার তাদের এত ভাল লাগার প্রধান কারন।
আর তারাই আমাদের সংস্থার সাথে সপৃক্ত একমাত্র বাঙালি জুটি।
আমি নিজে এখনো নিজের জন্য কাউকে পাইনি।
তাই ওদের দেখলে আমার মনে হয় যেন ওদের মাঝে আমি নিজেকে খুজে পাই।
ওদেরকে জানি প্রায় বছর খানেক হয়।
আর এতদিনে ওদের সাথে সংস্থার বাইরেও খুব ভাল একটা সম্পর্ক হয়ে যায় আমার।
আসলে ওদেরকে আমার নিজের পরিবারেরই একটা অংশ মনে হত।
তাই ওদের খুঁটিনাটি কোন বিষয়ই আমার অজানা ছিলনা।
নিলয় খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। বছর চারেক আগে স্কলারশিপ নিয়ে এখানে আসে।
আর এখানে আসার পর ফেসবুকের কল্যাণে স্বপনের সাথে পরিচয় হয় ওর।
স্বপন মফস্বলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে।
ছোট বেলায় মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়।
আর স্বপন তার চাচার ঘরে মানুষ হতে থাকে।
কিন্তু চাচার বড় সংসার আর সল্প আয়ের পরিবারে স্বপন অনেক অবহেলায়ই বড় হয়।
নিজেকে সব সময় একাই ভাবতে থাকে সে।
আর খুজে বেড়িয়েছে এমন কাউকে যাকে সে নিজের আপনজন বলে দাবী করতে পারে।
আর অদৃষ্টের ইশারায় একদিন নিলয়ের সাথে পরিচয় হয় তার।
আর অল্পদিনেই তাদের মাঝে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
পরে একসময় তাদের বন্ধুত্ব ভালবাসায় রূপ নেয়... তাদের ভালবাসা ফেসবুকের বেড়ী পেরিয়ে, ফোনালাপ, স্কাইপ ইত্যাদিতে গিয়ে পৌছায়।
কিন্তু তাদের সম্পর্কের মাঝে যেন কালের বাধা হয়ে দাড়ায় তাদের দূরত্ব।
আর এই বাধাটি ভাঙার উদ্যোগটা নিলয়ই নেয়।
নেদারল্যান্ডের কিছু বন্ধুর সহায়তা নিয়ে একসময় সে স্বপনকে তার কাছে নিয়ে আসে।
আর এখানে আসার পরেই দুজন সামনা সামনি দাড়িয়ে একে অপরকে নয়... তাদের অপার ভালবাসার সার্থকতাকে দেখছিল।
অবশেষে স্বপন খুজে পেয়েছিল তার আপনজনকে।
যাকে নিয়ে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে।
অপরদিকে নিলয়ও তার বহুকাল জিয়িয়ে রাখা ভালবাসাকে কারো নামে উৎসর্গ করার আনন্দে আত্বহারা। ভালই কাটছিল তাদের ভালবাসার ছোট্ট সংসার।
কিছুদিনের মধ্যেই স্বপন একটা চাকরির যোগাড় করে ফেলল।
আর তার পরে তাদের সংসার আরো একটু বেশি সমৃদ্ধ হল।
সকাল বেলা দু’জোড়া ঠোটের উষ্ণ ছোয়ায় ঘুম থেকে ওঠা।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাত ব্রাশ করার সময় থুতনিতে গুঁতো দিয়ে একে অপরকে হাসানো।
বাথটাবে দুজন দুজকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে মাথা ডুবিয়ে রাখা।
সকালের নাস্তা একে অপরের হাতে খাওয়া।
লাঞ্চ টাইম আলাদা আলাদা হওয়ায় একজন না খেয়ে বসে থেকে একসাথে খাওয়া শুরু করা।
আর খাওয়ার পুরো সময়টুকু ফোনালাপে একে অপরের সাথে মগ্ন থাকা।
কাজ শেষে বাসায় ফিরে স্বপনের রান্না করে নিলয়ের পথ চেয়ে থাকা।
দুজনে এক চাদরের নিচে শুয়ে কাল হো না হো , ভীর জারা বার বার দেখা।
তখন স্বপনের অশ্রুসজল চোখ দুটো মুছে দিয়ে তাতে আলতো করে চুমু খেতে কখনো ভুলেনি নিলয়। বিনিময়ে নিলয়ের বুকের দুর্বা ঘাসবনে নিজের মাথাটি গুজে দিতেও ভুল করেনি স্বপন।
তার পর দুটি টগবগে যৌবনদীপ্ত মানবের সবটুকু ভালবাসার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে একটি নতুন দিনের পথে এগিয়ে যাওয়া... এই ছিল ওদের দৈনন্দিন কার্যলিপি।
আর তার পরেই ঘটনা চক্রে আমি তাদের ছুটির দিনের মেহমান হয়ে গেলাম।
ভালই লাগত যখন ওরা দুজন তাদের ভালবাসার গল্প আমাকে শোনাত।
মনে মনে ভাবতাম কতটা ভাগ্যবান হলে কারো জীবনে এমন সুখ থাকতে পারে।
জীবনে অনেক সমপ্রেমীর জীবনে মিলনের সেতুবন্ধন হয়েছি আমি।
কিন্তু কখনো কারো ভালবাসাকে এতটা কাছ থেকে দেখিনি।
ওদের ভালবাসা দেখে নিজেকে ওদের মাঝেই পরিপূর্ণ মনে হত।
আর এই লোভেই বার বার ছুটে যেতাম ওদের ভালবাসার দ্বারে।
কখনো কখনো ওদের মাঝে ছোট ছোট কিছু বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলে, আমাকেই বিচারক হিসেবে মানত তারা।
আর সমাধানের পর ওদের মুখ দেখলে আমার নিজেরই সন্দেহ হত, আসলেই কি ওদের মাঝে ঝগড়া হয়েছিল!!
সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল পানির স্রোতের মত।
আর নিলয়-স্বপন ও ওদের ভালবাসার পানসি নায়ের দাড় টেনে যাচ্ছিল।
হঠাৎ তাদের সামনে বিশাল এক ঘূর্ণিঝড় হয়ে দেখা দিল তাদের নিয়তি।
তাদের স্বপ্নের ভবিষ্যতকে হতাশার কালো মেঘে ঢেকে দিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল নিলয়ের শিকড়... তার মা বাবা।
তারা নিলয়কে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে লাগল।
নিলয় তাদের একমাত্র সন্তান।
তাই নিলয়কে দেশে ফিরে গিয়ে বিয়ে করে সংসারী হবার জন্য নানা ভাবে বল প্রয়োগ করতে লাগল তারা। প্রথমে কিছুদিন তাদের বাহানা বানিয়ে রাখলেও এক সময় তাদের জেদের সামনে নিলয়ের চেষ্টা দুর্বল হতে লাগল।
আর এদিকে যেন বাগানের সেরা ফুল দুটি মলিন হয়ে যেতে লাগল।
স্বপনের এতটা আপন বলতে যেহেতু কেউ নেই তাই সে কারো ধার ধারে না।
নিলয়ের সাথে ইহজীবন কাটাতে সে সর্বাগ্রে প্রস্তুত।
কিন্তু নিলয় তার মা বাবাকে ছাড়তে পারবে না।
আর তাই সে পড়ল অনেক বড় এক দোটানায়।
এক দিকে তার ভালবাসা... অন্য দিকে বাস্তবতা... সে কোনটাই হারাতে চায়না।
কিন্তু সেকি আর হয় বটে... একটাকে পেতে হলে অন্যটাকে যে বিসর্জন দিতেই হবে।
ওরা যখন ব্যাপারটা আমাকে জানাল, তখন আমিও বাকশূন্য হয়ে গেলাম।
জানি এখানে বাকশূন্য হওয়া আমার সাজে না।
কারন এমন অনেকের সমস্যার সমাধান আমি করেছি।
কিন্তু তাদের ব্যাপার টা অন্য রকম ছিল।
কারন তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি আমাদের চেয়ে অনেক অনেক আলাদা।
তাই আমি এখানে কি জবাব দেব বুঝিনি।
আমি হয়ত পারতাম তাদের সব কিছু উপেক্ষা করে ভালবাসার পক্ষে থাকতে।
কিন্তু আমার বিবেক আমাকে বাধা দিচ্ছিল।
কারন যতই হোক বাবা মায়ের অবজ্ঞা করার বুদ্ধি আমি কাউকে দিতে পারিনা। আবার এদিকে মা বাবার কথা মানতে বললে একটা নিস্পাপ ভালবাসাকে গলা টিপে হত্যা করা হবে।
যা করতে আমার মন আমাকে বাধা দিচ্ছিল।
আর এ নিয়ে আমার মন আর বিবেকের মধ্যেই দ্বন্দের সৃষ্টি হল।
তাই মন আর বিবেকের মাঝে মধ্যস্ততা করতে আমারে নীরবই থাকতে হল...
এভাবে কিছুদিন চলতে থাকল।
এরই মধ্যে আমি দুটি নিস্পাপ ফুলের ঝড়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলাম।
আর এদিকে আমার নীরবতা নিলয় স্বপনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল আমার অপরাগতা।
হঠাৎ একদিন ওরা আমাদের সংস্থার চেয়ারম্যান ডঃ ফেন্সিন হ্যানরিকের সাথে দেখা করতে চাইল।
এ কথা শুনে আমার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেল।
মনে হল আমার শরীরে ১১০০ ভোল্টের বিদ্যুতের শক লাগল।
ফেন্সিনকে আমার চেয়ে ভাল আর কে চেনে।
সে এ পর্যন্ত অনেকেরই এমন সমস্যার সমাধান করেছে।
কিন্তু তার দেয়া বুদ্ধিতে এ পর্যন্ত অনেকের সম্পর্ক টিকে গেলেও ধ্বংস হয়েছে অধিকাংশের জীবন।
তাই আমি নিলয় ও স্বপনকে বার বার নিষেধ করলাম ফেন্সিনের সাথে দেখা করতে।
কিন্তু তারা মানতে নারাজ। স্বপন নিলয়কে ছাড়া থাকতে পারবে না।
আর নিলয় স্বপন ও তার পরিবার উভয়কেই চায়।
যেহেতু তারা আমার কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছিল না, তাই তাদের সামনে ফেন্সিন ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।
তারপরের আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম।
কিন্তু হঠাৎ একদিন নিলয় ও স্বপন আমার অগোচরেরই গিয়ে হাজির হল ফেন্সিনের অফিসে।
আর তারপর... যা হবার তাই হল... সব কিছু শোনার পর ফেন্সিন তাদের ভালবাসা ও পরিবার উভয়কে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য স্বপনকে Reassignment surgery (লিঙ্গান্তর) করার করার পরামর্শ দিল।
এতে সে স্ত্রী হয়ে সারা জীবন নিলয়ের সাথে থাকতে পারবে।
ফেন্সিনের রুমের ওই ২০মিনিট ওদের আরো বড় এক ভাবনায় ফেলে দিল।
ফিরে এসে যখন ওরা আমাকে জানালো তখন আমি ওদের অনেক আকুতি মিনতি করে বুঝালাম।
নিলয়ও ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না।
তাই সেও এতে তার অমতের কথা জানালো।
তাই এখন সব কিছু স্বপনের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করল।
কিন্তু স্বপন ফেন্সিনের অফিস থেকে আসার পর থেকেই কেমন জানি স্থবির হয়ে গেল।
তার মুখ থেকে সে একটা শব্দও করছিল না।
মনে হচ্ছিল সে অন্য কোন জগতে হারিয়ে গেছে।
জানিনা সে আমাদের কথা শুনছিল কিনা।
৩ দিন পর হঠাৎ সকাল বেলা নিলয়ের ফোন এল।
সে আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বাসায় যেতে বলল।
বুঝতেই পারছিলাম বড় কোন দুঃসংবাদ শুনতে যাচ্ছি আমি।
তড়িঘড়ি করে গিয়ে পৌছালাম ওদের বাসায়। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার সারা শরীর জমে আসছিল। পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
১০তলার উপরে ওদের ছোট্ট ঘরের বিশাল জানালায় দাড়িয়ে আছে স্বপন।
তার থেকেও প্রায় ১০ গজ দূরে ঘরের মাঝখানে বোবার মত দাড়িয়ে আছে নিলয়।
আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে অবুঝ শিশুর মত কাদতে লাগল নিলয়।
ওকে একটু শান্ত করার পর জানতে পারলাম সকালে ঘুম ভাঙার পর স্বপন নিলয়কে জানায় সে লিঙ্গান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একথা শোনার পর নিলয় রাজি না হলে স্বপন পাগলের মত আচরন করতে থাকে।
এক পর্যায়ে সে জানালার উপরে উঠে পড়ে এবং শর্ত দিয়ে দেয় তার লিঙ্গান্তর করায় রাজি না হলে বা তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করলে সে এখান থেকে লাফ দিবে।
অনেক বুঝানোর পরেও সে না মানলে নিলয় তার মা বাবাকে ত্যাগ করার কথা জানায়।
কিন্তু তাতেও সে রাজি হয়নি।
নিলয়কে শান্তনা দিয়ে আমি স্বপনকে বললাম,
- স্বপন তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? তুমি জানো Sex Reassignment surgery কতটা ভয়ংকর?
- আমি আর কিছু জানতে চাইনা অলক ভাইয়া। হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। কারন আমি নিলয়কে ভালবাসি। আর কতটা ভয়ংকর? কি হবে? বড়জোর মৃত্যু... আর নিলয়কে ছেড়ে আমাকে প্রতিদিন হাজার বার মরতে হবে। তার চেয়ে বরং একবারেই মরা ভাল... আমি অপারেশন করবই...
-স্বপন তুমি বোঝার চেষ্টা কর। নিলয় তোমার জন্য তার পরিবারকে ছাড়তে রাজি হয়েছে। তাহলে আর কি সমস্যা রইল?
-না ভাইয়া এ হতে পারেনা। মা বাবা ছাড়া বেচে থাকা যে কতটা কষ্টের তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে। আর আমি চাইনা আমার জন্য আমার নিলয় সেই কষ্ট ভোগ করুক। তাই এটাই বেস্ট আইডিয়া। এতে আমাদের সবারই মঙ্গল। যদি অপারেশন সাকসেসফুল হয় তাহলে আমরা সারা জীবন সুখে বাস করব। আর যদি আমি মারা যাই তাহলে নিলয় তার মা বাবার ইচ্ছায় বিয়ে করে সবাইকে নিয়ে ভাল থাকবে। তাই আমাকে সার্জারী করাতেই হবে...
আমি আবার নির্বাক হয়ে গেলাম। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলনা।
কি বা বলব, স্বপনের ভালবাসার গভীরতা আর আবেগের কাছে আমার সব যুক্তি ছোট হয়ে যাচ্ছিল...
আর এদিকে নিলয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অঝোরে কাদছিল...
অবশেষে স্বপনের জেদ আর ভালবাসার কাছে আমাদের হার মানতেই হল।
আমরা রাজি হলাম সার্জারীতে।
তখন দুচোখের অশ্রুকে চিরে স্বপনের মুখের হাসিটা দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসটাকে অর্জন করল।
হ্যাঁ দামি ই তো।
নিজের ভালবাসার চেয়ে দামী আর কি হতে পারে এ জগতে?
কিছুদিনের মধ্যেই নেদারল্যান্ডের কিছু বড় বড় LGBT সংস্থার সহায়তায় স্বপনের Reassignment surgery’র প্রস্তুতি শেষ হল।
অপারেশনের দিনও ঠিক হয়ে গেল।
অপারেশনের আগের রাতে শেষ বারের মত নিলয় স্বপনকে তার নিজের রুপে কাছে পেল।
এর পরে সে আর এ স্বপনকে দেখবে না।
তখন তার ভালবাসার রাজকুমার স্বপন তার সামনে রাজকুমারীর রুপে আসবে।
জানিনা ওই রাতটা তাদের কেমন কেটেছিল। আর জানতেও চাইনা।
অপারেশন শুরু হবার আগ মুহূর্তে স্বপন শেষ বারের মত নিজেকে আপন রুপে দেখল।
ছুয়ে দেখল নিজের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
আর শেষ বারের মত বুকে টেনে নিল নিলয়কে। কান্নায় ভেঙ্গে পরছিল নিলয়।
কিন্তু সেই তুলনায় স্বপনকে অনেকটা শক্তই মনে হচ্ছিল।
আসলেই ভালবাসা কখনো কখনো মানুষকে এতটা শক্ত করে তুলে যা ধারনা করা যায়না...
টানা ১৮ ঘণ্টা যাবত পর্যায়ক্রমে চলছিল অপারেশন।
অপারেশনটি কয়েকটা ধাপে হচ্ছিল।
আর প্রতিটা ধাপে তার শরীরের একেকটা অংশের সার্জারী করা হচ্ছিল।
১৮ ঘণ্টা পরে যখন শুনলাম অপারেশন শেষ হয়েছে এবং স্বপন সুস্থ আছে তখন অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশ মোতাবেক ৭২ ঘণ্টার আগে আমরা কেউ স্বপনের সাথে দেখা করতে পারলাম না। এই ৭২ ঘণ্টা নিলয়কে দেখে আমার খুব আফসোস হচ্ছিল।
আসলেই কি কেউ কাউকে এতটা ভালবাসতে পারে এ জগতে!
সত্যি আমার জীবনে অনেক বড় একটা ইতিহাস তৈরি করে দিল এ যুগল...
৭২ ঘণ্টা পরে যখন আমরা স্বপনকে দেখতে গেলাম তখন আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
এ কি দেখছি আমি।
হাসপাতালের বেডে যেখানে স্বপনের থাকার কথা সেখানে শুয়ে আছে অপরুপ সুন্দরী এক যুবতী।
যার সাথে স্বপনের কোন মিল খুজে পাচ্ছিলাম না আমি।
একবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাকে খুব স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবেই সে স্বপনের পাশে গিয়ে বসল।
যেন সে তার আগের স্বপনকেই দেখছে।
আমি কিছুটা অবাক হলাম নিলয়ের আচরনে।
সে স্বপনের পাশে বসে বলল,
-এখন কেমন লাগছে স্বপন?
-আমি স্বপন না! স্বপন তো সেই কবেই মরে গেছে। আমি স্বপ্না। নিলয়ের হবু স্ত্রী।
কথাটি শুনে আমি যেন বোকা বনে গেলাম।
আমি কি এই দুনিয়ায় আছি? এ কি দেখছি আমি।
স্বপন নামের সেই তরতাজা যুবকটির মুহূর্তের মধ্যে স্বপ্না হয়ে যাওয়া।
যেন স্বপন নামের কেউ ছিলই না কখনো।
আসলেই নিত্য নতুন প্রযুক্তির কত খেলাই না দেখা বাকি আছে আমাদের...
স্বপন ওরফে স্বপ্নার পুরোপুরি সুস্থ হতে মাস দুয়েক সময় লাগল।
আর এ সময়টা হাসপাতালে তার সেবায় নিজেকে পুরোপুরি ব্যস্ত করে রেখেছিল নিলয়।
পরে যখন স্বপ্নাকে নিয়ে সে ঘরে ফিরল তখন তাকে দেখে আরো একবার অবাক হতে হল আমাকে। কোমর অব্দি লম্বা চুল।
আর শারীরিক গঠনে এক পরিপুর্ন নারী।
দেখে বোঝার উপায় নেই এই স্বপ্নাই কদিন আগে স্বপন ছিল...
এদিকে নিলয় তার মা বাবাকে জানিয়ে দিল সে এখানে এক অনাথ বাঙালি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে ফেলেছে।
তার মা বাবা এতে কোণ বিরোধিতা করলনা।
তারা নিলয়কে বউ নিয়ে দেশে যেতে বলল।
অতঃপর আমরা নিলয়-স্বপ্নাকে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভকামনার সাথে বিদায় জানালাম।
ওরা চলে গেলেও আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হত।
শুনলাম নিলয়ের মা বাবা স্বপ্নাকে অনেক ধুমধামের সাথেই বরন করে নিয়েছে।
এবং দেশীয় নিয়মে তাদের বিয়ে করানো হয়েছে।
খুব সুখে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে তারা।
এসব শুনে নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছিল।
মনে মনে ভাবালাম যাক শেষ পর্যন্ত আমার প্রিয় জুটির মধুর মিলন হয়েছে...
ভেবে নিজে অনেক শান্তি পাচ্ছিলাম।
নিলয় স্বপ্নার গল্পটা এখানেই শেষ হলে পারত।
কিন্তু আমরা মানুষেরা নিজেদের গল্প যতই নিজেরা লেখার চেষ্টা করিনা কেন, বিধাতা তার লিখন অনেক অগেই লিখে রেখেছেন...
নিলয় স্বপ্নার বিয়ের ১ বছর হয়ে গেছে...
ইদানিং আমিও খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছি তার কারনে অনেকদিন হল নিলয় আর স্বপ্নার খোজ নেওয়া হয়না।
তাছাড়া কয়েক বছর হল দেশে যাইনা।
তাই কিছু দিনের ছুটি নিয়ে দেশে গেলাম।
নিলয়দের ঠিকানাটা জানা ছিল।
তাই ওদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য না জানিয়েই ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
আমাকে দেখে ওরা দুজনেই খুব খুশি হল।
পরে ওদের পরিবারের সবার সাথে পরিচিত হলাম।
তবে আমি বার বার স্বপ্নাকে দেখে খুব অবাক হচ্ছিলাম।
যে মেয়েটি আজ এই পরিবারের সকল আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে রেখেছে সারা পরিবারকে, এই কদিন আগেও তার পরিচয় একটি ছেলে হিসেবেই ছিল।
আর এ সত্য আমরা ৩ টি মানুষ ছাড়া আর কেউ জানেনা।
২দিন ওদের সাথে থাকার পরেই আমি কিছু জিনিস লক্ষ করলাম।
নিলয় আর স্বপ্নার মাঝে একটা অভুতপূর্ন মানসিক পরিবর্তন আমার চোখে পড়ল।
বুঝতে পারছিলাম এমন একটা কিছু আছে যা ওরা দুজনেই আমার কাছে ও পুরো দুনিয়ার কাছে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু কি সে ব্যাপার যা ওরা আমার কাছে গোপন রেখেছে!
ভাল করে লক্ষ করার পর আমার সন্দেহ চরমে গিয়ে পৌছাল...
তাই তাদের দুজনকে গোপনে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। কি সেই গোপনীয়তা।
শুরুতে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে তারা মুখ খুলতে বাধ্য হল।
আর যা শুনলাম তা বলার মত ভাষা আমার জানা নেই।
তবে ওদের মুখের কিছু কথা যা না বলে পারছিনা।
নিলয় বলল, -আমি সমকামী।
কখনো কোন মেয়ের মাঝে সেই সৌন্দর্য আমি খুজে পাইনি যা আমি একটা ছেলের মাঝে পেয়েছি।
আর আমার সারাজীবনের সবটুকু ভালবাসা দিয়েই ভালবেসেছি স্বপনকে। যে ছিল আমার সবকিছু।
কিন্তু ঘটনাক্রমে যখন স্বপন স্বপ্না হয়ে গেল তখন সব মেনে নিয়েছি নিজের ভালবাসার টানে।
ভেবেছি নিজের ভালবাসাকে বাচানোর আর কোন রাস্তা নেই। তাই করলাম। ভালই যাচ্ছিল।
কিন্তু দিন দিন যখন আমার কাছে মানসিক ভাবে অনুভব হতে লাগল যে এ স্বপন নয়।
এ স্বপ্না।
সে একজন মেয়ে...
এতে আমি ধীরে ধীরে ওর প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকি।
আর এখন আমি ওকে আর স্বপন ভাবতে পারিনা।
আমার ভালবাসার মানুষ ভাবতে পারিনা।
কি করব আমি এখন? অ
পরদিকে স্বপ্না বলল, -আমি বুঝতে শেখার পর থেকে এমন কাউকে কাছে পাইনি যাকে নিজের আপনজন বলে দাবী করতে পারি।
জীবনের ২১ বছর একাকিত্বের বোঝা তানার পর আমি নিলয়কে পেলাম।
ও আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে ভালবাসা কি।
আপনজনের ভালবাসা কি।
মায়া মমতা কি।
তাই আমার কাছে নিলয়ই আমার পৃথিবী।
নিলয়ই আমার সব।
তাই আমি আমার ভালবাসার পৃথিবীকে হারিয়ে আবার একা হয়ে চাইনি, আর চাইনি ওকেও ওর আপনজনের থেকে আলাদা করতে।
তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু আজ আমি আমার নিজের সিদ্ধান্তের কাছেই পরাজিত।
নিজের ভুল সংশোধন করার কোন রাস্তা আমার নেই।
আমি এখন কি করব???
ওদের এই প্রশ্ন দুটো আমাকে আবারো নির্বাক করা দিল।
আমার মনে আবারো প্রশ্ন জেগে উঠল, আমি এখন কি জবাব দেব?
জানি এই প্রশ্নেরও কোন জবাব আমার কাছে নেই।
বাকহীন ভাবে সেখান থেকে চলে এলাম।
আর নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।
যে আমি হাজারো মানুষের জীবনকে তাদের ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছি।
সেই আমি আজ আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দুটির জন্য কিছু করতে পারলাম না।
নিজের উপরে ঘৃনা জন্মে গেল।
কাল আমার ফ্লাইট নেদারল্যান্ডে।
কিন্তু আমি আর ফিরে যাবনা।
ফিরে যাবনা আর ওই জীবনে যে জীবনে ভালবাসার মানে শুধু বর্তমান।
নেই কোন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
একটি ভুল সিদ্ধান্ত যেখানে কেড়ে নেয় সবকিছু।
আমি চলে যাব অনেক দূরে।
নিলয় আর স্বপ্নার থেকে অনেক দূরে।
যেখানে গেলে ওদের শেষ পরিনতি আর দেখতে হবেনা আমাকে।
আর দেখতে চাইও না। আমি সইতে পারব না।
থাকুক ওরা আমার জন্যে আমার Unseen Future হয়ে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন