শিমুল রোজ এই রাস্তা দিয়ে যায় কিন্তু কখনও রাস্তার পাশে এতো সুন্দর বসার বেঞ্চ দেখেনি। এতো সুন্দর যে দেখলেই বসতে ইচ্ছে করে। সে কোন কাজে বের হয়েছিল কিনা মনে করতে পারলনা কিন্তু কিসের টানে যেন মোহিত হয়ে বেঞ্চিতে বসে পড়ল। বসার সাথে সাথেই কোথা থেকে একটা ছেলে এসে তার পাশে বসল। তার মতই ২৪/২৫ বছরের একটা ছেলে। ছেলেটাকে সে এই প্রথম দেখছে কিন্তু তাকে অনেক পরিচিত আর আপন মনে হচ্ছে তার কাছে। আজব ব্যাপার ছেলেটা যে কখন তার হাত ধরে গল্প করা শুরু করছে সে বুঝতে পারেনি কিন্তু ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা বরং যদি হাত না ধরত সেটাই তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হত। কি গল্প করে যাচ্ছে ছেলেটা সেসব কিছুই তার মাথায় ঢুকছেনা। আরে একি!!!! সুন্দর সেই বেঞ্চিটা এখন কামরান মিয়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চি মনে হচ্ছে। ছেলেটা কি সুন্দর চায়ের মধ্যে ডালপুরি ভিজিয়ে খাচ্ছে। তাকেও মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে কিন্তু ব্যাপার কি কামরান মিয়ার পুরীগুলো আজকে এমন পানসে লাগছে কেন। চিবুতেও কিরকম জানি লাগছে আর কোন স্বাদ বুঝা যাচ্ছেনা। ওরা চা খাচ্ছে এর মাঝে শিমুলের মেঝ ভাই যিনি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে থাকেন হঠাৎ তিনি কোথা থেকে জানি সামনে এসে দাঁড়ালেন।
-কিরে তুই এখানে???? আর আমি তোকে খুঁজে মরছি। আমার বাইকের চাবিটা দেখেছিস? খুঁজে পাচ্ছিনা।
শিমুলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি যেমন উল্কার বেগে এসেছিলেন ঠিক তেমনি উল্কার বেগেই চলে গেলেন। একবারও জিজ্ঞেস করলেননা, এই ছেলেটা তোকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে কেন। এখানেই শেষ না। শিমুলের জন্য যে আরও নাটকীয়তা বাকি রয়েছে।
কামরান মিয়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চকে এখন মনে হচ্ছে মতিন আঙ্কেলের পাকিস্তানি আমলের জাপানি CD-80 মোটর সাইকেল যেটারে এলাকার পোলাপান আড়ালে আবডালে পালসার বলে কিন্তু ব্যাপার কি আজকে একবারও ওটার স্টার্ট বন্ধ হচ্ছেনা আর স্পীডও ও যেন ১৫০সি সি পালসার থেকে দুইগুণ বেশি তবে অবাক করা বিষয় হোন্ডাটা মতিন আঙ্কেল না ওই ছেলেটা চালাচ্ছে।শিমুল তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।এতো এতো আজিব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু সেগুলো শিমুলকে মোটেও স্পর্শ করছেনা যেন এরকমই হবার কথা। নাহ,এই অবস্থায়ও শিমুলকে বেশিক্ষণ থাকতে হল না।এবার সে নিজেকে আবিষ্কার করল একটা খালি মাঠে যেখানে কোন ফসল নাই শুধু ধু ধু মাঠ।সে 'ষষ্টি' বলে চিৎকার করে ডাকছে কিন্তু কেউ শুনছেনা।তাকে কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সে নিশ্চিত বুঝতে পারছে সে ওই ছেলেটিকেই ডাকছে। ষষ্টিইইইইইইইইইই ইইইইই.......
-কিরে ষওওওও শব্দ কি করছিস? স্বপ্ন দেখছিলি?
মায়ের কথায় শিমুলের ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারল সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার।মনে হচ্ছে মা সব বুঝে গেছে।
-তাড়াতাড়ি উঠ, বাজারে যেতে হবে।
এই বলে মা চলে গেলেন। নাস্তা করতে গিয়ে বুঝতে পারল সে ভাল যন্ত্রণায় পড়েছে। কিরকম জানি অস্বস্তি লাগছে, যা কাউকে বুঝানো যাবেনা আর বুঝানো গেলেও এরকম স্বপ্নের কথা যে কাউকে বলা যায়না এটা সে জানে। মাথায় খালি ষষ্টি ষষ্টি নামটা বাজছে। রাস্তায় একটা ছেলেকে দেখে শিমুল থমকে দাঁড়াল। আরে এই ছেলেকেইতো রাতে স্বপ্নে দেখেছে সে।হা করে ছেলের দিকে থাকিয়ে থাকল কিছু বলার আর সুযোগ পেলনা। তার আগেই ছেলেটা একটা তরুণীর হাত ধরে পগারপার। বাজার করতে গিয়ে তরকারিওয়ালার দিকে চেয়ে আবার তার পিলে চমকে গেল। রাস্তার ওই ছেলে না,এই ছেলেই স্বপ্নে এসেছিল।
-কেমন আছেন ভাই? তরকারির কুশল জিজ্ঞেস না করে তরকারিওয়ালার কুশল জিজ্ঞেস করায় লোকটা কিছুটা অবাকই হল।তার মুখে স্পষ্ট তা ফুটে উঠেছে কিন্তু শিমুলের সেদিকে খেয়াল নাই।সে কথা বলেই যাচ্ছে।
-আপনাকেতো আগে দেখিনি,নতুন এসেছেন বুঝি?
-জ্বি ভাইজান,নতুন এসেছি।
-আপনার তরকারিগুলা অনেক সুন্দর,আপনার নাম কি? প্রশ্ন করেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।সে এসব কি করছে, সে কি পাগল হয়ে গেল? লোকটাকে এসব অবান্তর কথা বলার কোন মানে হয়না।
-আমার নাম জসিম মিয়া ভাইজান। ও আচ্ছা বলে সে চলে এলো ওখান থেকে। শিমুল বুঝতে পারছেনা তার কি হয়েছে।কোন অপরিচিত মুখ দেখলেই তার কাছে মনে হচ্ছে এই সেই ছেলে যাকে সে স্বপ্নে চিৎকার করে ডাকছিল।তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।সারাদিন থেকে মাথায় শুধু একটা নামই বাজতেছে। পরদিন ক্লাসের শেষে উৎপলের সাথে গল্প করছিল শিমুল।
-আচ্ছা উৎপল তোর জানামতে কোন ছেলে আছে যার না ষষ্টি?
-আছেতো,আমাদের পাশের বাড়ির এক কাকাত ভাইয়ের নাম ষষ্টিচরণ। কিন্তু হঠাৎ এই কথা জানতে চাচ্ছিস কেন?
-না এমনি,একটা বইতে নামটা পড়ছিলাম।কেমন অদ্ভুত নাম তাই জিজ্ঞেস করলাম।
-ও আচ্ছা।
-এই চল না তোদের গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।দিনে দিনে ঘুরে চলে আসব।
-কি ব্যাপার বলতো?কতদিন বললাম চল যাই গেলিনা আর আজ নিজে থেকে বলছিস।
-আরে ব্যাপার আবার কি,শহরে থাকতে থাকতে একঘেয়ে লাগছে তাই একটু যেতে চাইলাম। তুই না চাইলে যাবনা।
-ধুর পাগল,আমি কি সেই কথা বলছি।আচ্ছা বল কবে যাবি?
-পরশুদিনতো ভার্সিটি অফ,চল ওইদিনই যাই।
-ঠিক আছে,তাইলে পরশু ভোঁরে রওয়ানা দিতে হবে তাইলে দিনেদিনে ঘুরে চলে আসা যাবে।
-ওক্কে দোস্ত।
শিমুলের মনেহল সে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে,কি না কি স্বপ্নে দেখছে আর এটা নিয়ে অযথা মাথা ঘামাচ্ছে।আবার পরক্ষণেই মনেহল দেখি ই না একটু চেষ্টা করে,যে মানুষটার জন্য এতদিন থেকে অপেক্ষা করছি হয়ত তাকে পেয়েও যেতে পারি।
পরদিন দুপুরে ওরা হবিগঞ্জে উৎপলের গ্রামের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল।হাত মুখ ধুয়ে খেয়েধেয়ে ওরা গ্রাম দেখতে বের হল। উৎপল বলল,জানিসতো আমাদের গ্রাম হল এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রাম।
-জানিরে বাপ,সাধারণ জ্ঞানের বই ছাড়াও তোর মুখে যে এটা কতবার শুনছি তা হিসেব ছাড়া।
-আরে গাধা আমি কি তোদের এই 'বানিয়াচং' গ্রাম দেখার জন্য এতো দূর থেকে কষ্ট করে এসেছি, আমিতো এসেছি আমার ষষ্টিকে দেখার জন্য। এটা অবশ্য মনেমনেই বলল। শিমুল ভেতর ভেতর উশখুশ করছে উৎপলকে কিভাবে ষষ্টির কথা বলবে। কোন একটা প্রসঙ্গ টেনে এনে বলতে হবে নইলে আবার কি না কি মনে করবে। উৎপল তাকে এটা ওটা দেখাচ্ছে কিন্তু তার মন পড়ে আছে ষষ্টিচরণের ভাবনায়। সে কি তার স্বপ্নের মত হবে?ষষ্টির সাথে সে কিভাবে কথা বলবে।এইসব সাতপাঁচ ভাবছে কিন্তু মাথায় কোন বুদ্ধিই আসছেনা।কিভাবে ষষ্টির প্রসঙ্গ তুলা যায়। হঠাৎ উৎপল বলল,এই শিমুল তুই ষষ্টি দা'র কথা বলছিলি না?ওই যে ষষ্টি দা'দের বাড়ি।যাবি নাকি উনাদের বাড়ি? শিমুল মনেমনে ভাবল,একেই বলে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।একেবারে বাড়িই পেয়ে গেছি।কিন্তু মুখে বলল আরেক কথা।
-যাবি?তুই গেলেতো যাব।
-আরে তুই ওইদিন নাম বলছিলি তাই বললাম। আমরা তেমন একটা যাইনা।তাইলে থাক যাবনা।
শিমুল মনেমনে নিজেকে নিজে একশ একটা গালি দিল। আরে কি দরকার ছিল তোর উৎপলের কাছে এতো ভাব ধরার। এখন বুঝ মজা এতদূর থেকে এসে একেবারে বাড়ির মুখে এসেও স্বপ্নের মানুষের বাড়ি যেতে পারলিনা। এ যে তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা। হঠাৎ মনেহল সে যদি উৎপলকে বলে যে,তার পানির তৃষ্ণা পেয়েছে তাইলে হয়তো উৎপল তাকে ওই বাড়িতেই নিয়ে যাবে কারণ আশেপাশে আর কোন বাড়ি নেই।
-উফফফ!এতো রোদ উঠেছে রে, খুব পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। দেখতো আশেপাশে কোন দোকান আছে কিনা? উৎপলকে বলল শিমুল।
-এটা আপনার শহর না যে একটু পরপর দোকান পাবা আর পেলেও পানি পাবেনা। পয়সা দিয়ে কিনে পানি খেতে হয় এটা গ্রামের লোকেদের কল্পনায়ও নেই তাই দোকানে কেউ পানি রাখেনা। তারচেয়ে চল ষষ্টি দা'দের বাড়ি গিয়ে পানি খেয়ে চলে আসি। যাক মাছ টোপ গিলছে ভাবল শিমুল আর মনেমনে বলল, “আরে গাধা আমিতো দেখতেই পাচ্ছি আশেপাশে দোকানপাট নাই আর সেজন্যইতো এই পানি খাওয়ার নাটকটা করা।” শিমুল মুখে এমন ভাব ফুটিয়ে বলল, কি আর করা ,চল তাইলে ওবাড়িতেই যাই।যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় শুধু পানি খাওয়ার জন্যই যাচ্ছে। বাড়ির ভেতর ঢুকে উৎপল ডাক দিল, ষষ্টি'দা বাড়িত আছইন নি? ভেতর থেকে ১৫/১৬বছরের একটা মেয়ে বের হয়ে বলল, বাবা ক্ষেতো কাম করতা গেছইন।
-তোমার মারে কও ঠাকুর বাড়ি থাকি কাকা আইছইন,একটু জল খাইতা।
উৎপলের মুখে হবিগঞ্জের আঞ্চলিক কথা শুনে এতক্ষণে শিমুল হাসতে হাসতে মরে যেত কিন্তু তার কানে এসব কিছুই যাচ্ছেনা। এতো বড় মেয়ে যদি ষষ্টির হয় তাইলে ষষ্টির বয়স কত হবে, এসব চিন্তাই শিমুলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওরা বারান্দায় পাতা পাটিতে বসল। ভেতর থেকে ৩৫/৪০বছর বয়স হবে এমন একজন মহিলা একটা প্লেটে নারকেলের নাড়ু আর পানি নিয়ে এলেন।
-''আরে বৌদি ইতা কেরে আনতে গেলাইন কইন ছেন'' বলে উৎপল পরিচয় করিয়ে দিল শিমুলকে ষষ্টির স্ত্রীর সাথে।
-তুমি রে'বো আমরারে ভুইল্লা ওই গেছ,এখন দি আওই না।
-না গো বৌদি,পড়ালেখার চাপে বাড়িতই আইতাম ফারিনা।আইলে তুমরার ওনোও আইতাম।
উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বের হয়ে গেল। শিমুল ষষ্টির মেয়ে আর বউকে দেখে ষষ্টিকে দেখার আর সাহস করতে পারলনা। ফেরার পথে মাঠে প্রায় মধ্যবয়স্ক একটা লোককে দেখিয়ে উৎপল বলল আরে ওইযে ষষ্টি'দা। চল দেখা করে আসি। উৎপলের কথা শুনে লোকটার দিকে তাকিয়ে শিমুলের মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বের হয়ে এল ''OHHH MY GOD"
-কি হয়েছে রে?
-না তোদের মাঠটাতো এতো বড় তাই বললাম।তুই যা দেখা করে আয়, আমি ওই গাছের নীচে বসি। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা করছে।
ওইদিন ওদেরকে হবিগঞ্জেই থাকতে হল।উৎপলের মা কিছুতেই একদিন না রেখে ওদেরকে আসতে দিবেন না। রাতে শুয়ে শুয়ে শিমুল ভাবল অনেক পাগলামি হয়েছে আর না।ষষ্টির ভুত এখানেই দাহ করে সিলেট যেতে হবে।
সিলেট এসেছে ওরা আজ ৫দিন হল।অনেক কষ্টে ষষ্টির ভূত মাথা থেকে নামিয়েছে শিমুল। এর আরও ২/৩দিন পর ওর মেঝ ভাই রুমেল যিনি ডাবলিনে থাকেন তিনি ফোন দিলেন শিমুলকে।
-হ্যাঁ শোন, এখানে আমার সাথে একটা ছেলে কাজ করে। ওর দেশের বাড়ি ভৈরবে।
-কি হইছে তার? পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলছে?
-ফাজলামি করবিনা, একটা থাপ্পড় খাবি।
-আচ্ছা ঠিক আছে,বল।
-সে দুই সপ্তাহ হল দেশে এসেছে।ওর সাথে তোদের জন্য আমি কিছু জিনিসপত্র দিছি সে ওগুলো দিতে সিলেট আসবে আর এখানে কিছুদিন বেড়াবে।
-কবে আসবেন উনি?
-এইতো দু'একদিনের ভেতর হয়তো আসবে।আমি ওকে তোর সেল নাম্বার দিছি সে তোকে ফোন করবে।
-আচ্ছা
-শোন,তুই ওকে ষ্টেশন থেকে এগিয়ে নিয়ে আসবি আর সে যতদিন সিলেট থাকবে আমাদের বাসায় থাকবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-যেখানে যেখানে যেতে চায় নিয়ে যাবি। ওর যেন কোন অযত্ন না হয়। নইলে আমি খুব লজ্জা পাব।
-তুমি কোন চিন্তা করনাতো, জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে আমি লজ্জার হাত থেকে বাঁচাব।হাঃহাঃহা ...
-আবার ফাজলামি! আম্মাকে দে এখন।
শিমুল মায়ের কাছে ফোনটা দিয়ে চলে গেল। পরদিন দুপুরে খেতে বসেছে এমন সময় অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে শিমুলের মোবাইলে কল এল।
-হ্যালো
-হ্যালো, এটা কি শিমুলের নাম্বার?
-হ্যাঁ,আপনি কে বলছেন?
-আমি ষষ্টি, রুমেলের বন্ধু।
-ষষ্টিইই!!!!!!! !!!
বলেই শিমুলের গলায় ভাত আটকে গেল। ওপাশ থেকে বেচারা ষষ্টি বলে যাচ্ছে, হ্যালো শিমুল।আপনি ঠিক আছেনতো। হ্যালো শিমুল,হ্যালো হ্যালো....
পুনশ্চঃ ''নিষিদ্ধ নীরব'' যে আমার স্ট্যাটাসে আমার এই স্বপ্নের কথা শুনে আমাকে এটা নিয়ে একটা অনুগল্প লিখতে বলছিল। সে না বললে হয়তো বিষয়টা মাথায়ই আসতনা। এবং আদিত্য রায়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ এত সুন্দর করে আমাকে হবিগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা অনুবাদ করে দেয়ার জন্য
-কিরে তুই এখানে???? আর আমি তোকে খুঁজে মরছি। আমার বাইকের চাবিটা দেখেছিস? খুঁজে পাচ্ছিনা।
শিমুলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি যেমন উল্কার বেগে এসেছিলেন ঠিক তেমনি উল্কার বেগেই চলে গেলেন। একবারও জিজ্ঞেস করলেননা, এই ছেলেটা তোকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে কেন। এখানেই শেষ না। শিমুলের জন্য যে আরও নাটকীয়তা বাকি রয়েছে।
কামরান মিয়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চকে এখন মনে হচ্ছে মতিন আঙ্কেলের পাকিস্তানি আমলের জাপানি CD-80 মোটর সাইকেল যেটারে এলাকার পোলাপান আড়ালে আবডালে পালসার বলে কিন্তু ব্যাপার কি আজকে একবারও ওটার স্টার্ট বন্ধ হচ্ছেনা আর স্পীডও ও যেন ১৫০সি সি পালসার থেকে দুইগুণ বেশি তবে অবাক করা বিষয় হোন্ডাটা মতিন আঙ্কেল না ওই ছেলেটা চালাচ্ছে।শিমুল তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।এতো এতো আজিব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু সেগুলো শিমুলকে মোটেও স্পর্শ করছেনা যেন এরকমই হবার কথা। নাহ,এই অবস্থায়ও শিমুলকে বেশিক্ষণ থাকতে হল না।এবার সে নিজেকে আবিষ্কার করল একটা খালি মাঠে যেখানে কোন ফসল নাই শুধু ধু ধু মাঠ।সে 'ষষ্টি' বলে চিৎকার করে ডাকছে কিন্তু কেউ শুনছেনা।তাকে কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সে নিশ্চিত বুঝতে পারছে সে ওই ছেলেটিকেই ডাকছে। ষষ্টিইইইইইইইইইই
-কিরে ষওওওও শব্দ কি করছিস? স্বপ্ন দেখছিলি?
মায়ের কথায় শিমুলের ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারল সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার।মনে হচ্ছে মা সব বুঝে গেছে।
-তাড়াতাড়ি উঠ, বাজারে যেতে হবে।
এই বলে মা চলে গেলেন। নাস্তা করতে গিয়ে বুঝতে পারল সে ভাল যন্ত্রণায় পড়েছে। কিরকম জানি অস্বস্তি লাগছে, যা কাউকে বুঝানো যাবেনা আর বুঝানো গেলেও এরকম স্বপ্নের কথা যে কাউকে বলা যায়না এটা সে জানে। মাথায় খালি ষষ্টি ষষ্টি নামটা বাজছে। রাস্তায় একটা ছেলেকে দেখে শিমুল থমকে দাঁড়াল। আরে এই ছেলেকেইতো রাতে স্বপ্নে দেখেছে সে।হা করে ছেলের দিকে থাকিয়ে থাকল কিছু বলার আর সুযোগ পেলনা। তার আগেই ছেলেটা একটা তরুণীর হাত ধরে পগারপার। বাজার করতে গিয়ে তরকারিওয়ালার দিকে চেয়ে আবার তার পিলে চমকে গেল। রাস্তার ওই ছেলে না,এই ছেলেই স্বপ্নে এসেছিল।
-কেমন আছেন ভাই? তরকারির কুশল জিজ্ঞেস না করে তরকারিওয়ালার কুশল জিজ্ঞেস করায় লোকটা কিছুটা অবাকই হল।তার মুখে স্পষ্ট তা ফুটে উঠেছে কিন্তু শিমুলের সেদিকে খেয়াল নাই।সে কথা বলেই যাচ্ছে।
-আপনাকেতো আগে দেখিনি,নতুন এসেছেন বুঝি?
-জ্বি ভাইজান,নতুন এসেছি।
-আপনার তরকারিগুলা অনেক সুন্দর,আপনার নাম কি? প্রশ্ন করেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।সে এসব কি করছে, সে কি পাগল হয়ে গেল? লোকটাকে এসব অবান্তর কথা বলার কোন মানে হয়না।
-আমার নাম জসিম মিয়া ভাইজান। ও আচ্ছা বলে সে চলে এলো ওখান থেকে। শিমুল বুঝতে পারছেনা তার কি হয়েছে।কোন অপরিচিত মুখ দেখলেই তার কাছে মনে হচ্ছে এই সেই ছেলে যাকে সে স্বপ্নে চিৎকার করে ডাকছিল।তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।সারাদিন থেকে মাথায় শুধু একটা নামই বাজতেছে। পরদিন ক্লাসের শেষে উৎপলের সাথে গল্প করছিল শিমুল।
-আচ্ছা উৎপল তোর জানামতে কোন ছেলে আছে যার না ষষ্টি?
-আছেতো,আমাদের পাশের বাড়ির এক কাকাত ভাইয়ের নাম ষষ্টিচরণ। কিন্তু হঠাৎ এই কথা জানতে চাচ্ছিস কেন?
-না এমনি,একটা বইতে নামটা পড়ছিলাম।কেমন অদ্ভুত নাম তাই জিজ্ঞেস করলাম।
-ও আচ্ছা।
-এই চল না তোদের গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।দিনে দিনে ঘুরে চলে আসব।
-কি ব্যাপার বলতো?কতদিন বললাম চল যাই গেলিনা আর আজ নিজে থেকে বলছিস।
-আরে ব্যাপার আবার কি,শহরে থাকতে থাকতে একঘেয়ে লাগছে তাই একটু যেতে চাইলাম। তুই না চাইলে যাবনা।
-ধুর পাগল,আমি কি সেই কথা বলছি।আচ্ছা বল কবে যাবি?
-পরশুদিনতো ভার্সিটি অফ,চল ওইদিনই যাই।
-ঠিক আছে,তাইলে পরশু ভোঁরে রওয়ানা দিতে হবে তাইলে দিনেদিনে ঘুরে চলে আসা যাবে।
-ওক্কে দোস্ত।
শিমুলের মনেহল সে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে,কি না কি স্বপ্নে দেখছে আর এটা নিয়ে অযথা মাথা ঘামাচ্ছে।আবার পরক্ষণেই মনেহল দেখি ই না একটু চেষ্টা করে,যে মানুষটার জন্য এতদিন থেকে অপেক্ষা করছি হয়ত তাকে পেয়েও যেতে পারি।
পরদিন দুপুরে ওরা হবিগঞ্জে উৎপলের গ্রামের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল।হাত মুখ ধুয়ে খেয়েধেয়ে ওরা গ্রাম দেখতে বের হল। উৎপল বলল,জানিসতো আমাদের গ্রাম হল এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রাম।
-জানিরে বাপ,সাধারণ জ্ঞানের বই ছাড়াও তোর মুখে যে এটা কতবার শুনছি তা হিসেব ছাড়া।
-আরে গাধা আমি কি তোদের এই 'বানিয়াচং' গ্রাম দেখার জন্য এতো দূর থেকে কষ্ট করে এসেছি, আমিতো এসেছি আমার ষষ্টিকে দেখার জন্য। এটা অবশ্য মনেমনেই বলল। শিমুল ভেতর ভেতর উশখুশ করছে উৎপলকে কিভাবে ষষ্টির কথা বলবে। কোন একটা প্রসঙ্গ টেনে এনে বলতে হবে নইলে আবার কি না কি মনে করবে। উৎপল তাকে এটা ওটা দেখাচ্ছে কিন্তু তার মন পড়ে আছে ষষ্টিচরণের ভাবনায়। সে কি তার স্বপ্নের মত হবে?ষষ্টির সাথে সে কিভাবে কথা বলবে।এইসব সাতপাঁচ ভাবছে কিন্তু মাথায় কোন বুদ্ধিই আসছেনা।কিভাবে ষষ্টির প্রসঙ্গ তুলা যায়। হঠাৎ উৎপল বলল,এই শিমুল তুই ষষ্টি দা'র কথা বলছিলি না?ওই যে ষষ্টি দা'দের বাড়ি।যাবি নাকি উনাদের বাড়ি? শিমুল মনেমনে ভাবল,একেই বলে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।একেবারে বাড়িই পেয়ে গেছি।কিন্তু মুখে বলল আরেক কথা।
-যাবি?তুই গেলেতো যাব।
-আরে তুই ওইদিন নাম বলছিলি তাই বললাম। আমরা তেমন একটা যাইনা।তাইলে থাক যাবনা।
শিমুল মনেমনে নিজেকে নিজে একশ একটা গালি দিল। আরে কি দরকার ছিল তোর উৎপলের কাছে এতো ভাব ধরার। এখন বুঝ মজা এতদূর থেকে এসে একেবারে বাড়ির মুখে এসেও স্বপ্নের মানুষের বাড়ি যেতে পারলিনা। এ যে তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা। হঠাৎ মনেহল সে যদি উৎপলকে বলে যে,তার পানির তৃষ্ণা পেয়েছে তাইলে হয়তো উৎপল তাকে ওই বাড়িতেই নিয়ে যাবে কারণ আশেপাশে আর কোন বাড়ি নেই।
-উফফফ!এতো রোদ উঠেছে রে, খুব পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। দেখতো আশেপাশে কোন দোকান আছে কিনা? উৎপলকে বলল শিমুল।
-এটা আপনার শহর না যে একটু পরপর দোকান পাবা আর পেলেও পানি পাবেনা। পয়সা দিয়ে কিনে পানি খেতে হয় এটা গ্রামের লোকেদের কল্পনায়ও নেই তাই দোকানে কেউ পানি রাখেনা। তারচেয়ে চল ষষ্টি দা'দের বাড়ি গিয়ে পানি খেয়ে চলে আসি। যাক মাছ টোপ গিলছে ভাবল শিমুল আর মনেমনে বলল, “আরে গাধা আমিতো দেখতেই পাচ্ছি আশেপাশে দোকানপাট নাই আর সেজন্যইতো এই পানি খাওয়ার নাটকটা করা।” শিমুল মুখে এমন ভাব ফুটিয়ে বলল, কি আর করা ,চল তাইলে ওবাড়িতেই যাই।যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় শুধু পানি খাওয়ার জন্যই যাচ্ছে। বাড়ির ভেতর ঢুকে উৎপল ডাক দিল, ষষ্টি'দা বাড়িত আছইন নি? ভেতর থেকে ১৫/১৬বছরের একটা মেয়ে বের হয়ে বলল, বাবা ক্ষেতো কাম করতা গেছইন।
-তোমার মারে কও ঠাকুর বাড়ি থাকি কাকা আইছইন,একটু জল খাইতা।
উৎপলের মুখে হবিগঞ্জের আঞ্চলিক কথা শুনে এতক্ষণে শিমুল হাসতে হাসতে মরে যেত কিন্তু তার কানে এসব কিছুই যাচ্ছেনা। এতো বড় মেয়ে যদি ষষ্টির হয় তাইলে ষষ্টির বয়স কত হবে, এসব চিন্তাই শিমুলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওরা বারান্দায় পাতা পাটিতে বসল। ভেতর থেকে ৩৫/৪০বছর বয়স হবে এমন একজন মহিলা একটা প্লেটে নারকেলের নাড়ু আর পানি নিয়ে এলেন।
-''আরে বৌদি ইতা কেরে আনতে গেলাইন কইন ছেন'' বলে উৎপল পরিচয় করিয়ে দিল শিমুলকে ষষ্টির স্ত্রীর সাথে।
-তুমি রে'বো আমরারে ভুইল্লা ওই গেছ,এখন দি আওই না।
-না গো বৌদি,পড়ালেখার চাপে বাড়িতই আইতাম ফারিনা।আইলে তুমরার ওনোও আইতাম।
উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বের হয়ে গেল। শিমুল ষষ্টির মেয়ে আর বউকে দেখে ষষ্টিকে দেখার আর সাহস করতে পারলনা। ফেরার পথে মাঠে প্রায় মধ্যবয়স্ক একটা লোককে দেখিয়ে উৎপল বলল আরে ওইযে ষষ্টি'দা। চল দেখা করে আসি। উৎপলের কথা শুনে লোকটার দিকে তাকিয়ে শিমুলের মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বের হয়ে এল ''OHHH MY GOD"
-কি হয়েছে রে?
-না তোদের মাঠটাতো এতো বড় তাই বললাম।তুই যা দেখা করে আয়, আমি ওই গাছের নীচে বসি। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা করছে।
ওইদিন ওদেরকে হবিগঞ্জেই থাকতে হল।উৎপলের মা কিছুতেই একদিন না রেখে ওদেরকে আসতে দিবেন না। রাতে শুয়ে শুয়ে শিমুল ভাবল অনেক পাগলামি হয়েছে আর না।ষষ্টির ভুত এখানেই দাহ করে সিলেট যেতে হবে।
সিলেট এসেছে ওরা আজ ৫দিন হল।অনেক কষ্টে ষষ্টির ভূত মাথা থেকে নামিয়েছে শিমুল। এর আরও ২/৩দিন পর ওর মেঝ ভাই রুমেল যিনি ডাবলিনে থাকেন তিনি ফোন দিলেন শিমুলকে।
-হ্যাঁ শোন, এখানে আমার সাথে একটা ছেলে কাজ করে। ওর দেশের বাড়ি ভৈরবে।
-কি হইছে তার? পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলছে?
-ফাজলামি করবিনা, একটা থাপ্পড় খাবি।
-আচ্ছা ঠিক আছে,বল।
-সে দুই সপ্তাহ হল দেশে এসেছে।ওর সাথে তোদের জন্য আমি কিছু জিনিসপত্র দিছি সে ওগুলো দিতে সিলেট আসবে আর এখানে কিছুদিন বেড়াবে।
-কবে আসবেন উনি?
-এইতো দু'একদিনের ভেতর হয়তো আসবে।আমি ওকে তোর সেল নাম্বার দিছি সে তোকে ফোন করবে।
-আচ্ছা
-শোন,তুই ওকে ষ্টেশন থেকে এগিয়ে নিয়ে আসবি আর সে যতদিন সিলেট থাকবে আমাদের বাসায় থাকবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-যেখানে যেখানে যেতে চায় নিয়ে যাবি। ওর যেন কোন অযত্ন না হয়। নইলে আমি খুব লজ্জা পাব।
-তুমি কোন চিন্তা করনাতো, জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে আমি লজ্জার হাত থেকে বাঁচাব।হাঃহাঃহা
-আবার ফাজলামি! আম্মাকে দে এখন।
শিমুল মায়ের কাছে ফোনটা দিয়ে চলে গেল। পরদিন দুপুরে খেতে বসেছে এমন সময় অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে শিমুলের মোবাইলে কল এল।
-হ্যালো
-হ্যালো, এটা কি শিমুলের নাম্বার?
-হ্যাঁ,আপনি কে বলছেন?
-আমি ষষ্টি, রুমেলের বন্ধু।
-ষষ্টিইই!!!!!!!
বলেই শিমুলের গলায় ভাত আটকে গেল। ওপাশ থেকে বেচারা ষষ্টি বলে যাচ্ছে, হ্যালো শিমুল।আপনি ঠিক আছেনতো। হ্যালো শিমুল,হ্যালো হ্যালো....
পুনশ্চঃ ''নিষিদ্ধ নীরব'' যে আমার স্ট্যাটাসে আমার এই স্বপ্নের কথা শুনে আমাকে এটা নিয়ে একটা অনুগল্প লিখতে বলছিল। সে না বললে হয়তো বিষয়টা মাথায়ই আসতনা। এবং আদিত্য রায়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ এত সুন্দর করে আমাকে হবিগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা অনুবাদ করে দেয়ার জন্য
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন