২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

শঙ্খ প্রেমের গল্প

সামনে বিস্তীর্ণ চারণভূমি। বর্ষার শেষে যা তিন গ্রামের আমিষের চাহিদা মেটায়। আবার ঋতুর বদলে কখনো ঈরির বলক, কখনো হলদেছেটা সরষে ক্ষেত, আবার কখনো উদোম বালকদের খেলার মাঠে রূপ নেয় এ ভূমি। আর এর সাথেই বিশাল এক টিলার মত হয়ে আছে শত বর্ষের পুরনো একটি গ্রাম। ছয় ঋতুর ছয়টি স্বাদ উপভোগের জন্য এর চেয়ে যোগ্য কোন স্থান খুজে পাওয়া মুশকিল। সময়টি নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হলেও এখানে যেন ক্যালেন্ডার এখনো সেই সত্তরের দশকেই আটকে আছে। এখনো ট্যান্ডেস্টার টাইপের যন্ত্রের বিশেষ ব্যবহার দেখা যায় এখানে। এখনো বিয়ের দেন দরবারের তালিকায় সুউচ্চ স্থান করে নেয় একটি সোনালি রঙের সিকো ফাইভ ঘড়ি নয়ত একটি বাংলা সাইকেল। আর বেশি ধনবান হলে একটি ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশন...

এমনি এক থমকে থাকা গ্রামের দুরন্ত কিশোর আসাদ ও নুর। বয়েস আর কত ১১/১২ হবে। আর বুঝে উঠার পর থেকে এই পর্যন্ত দুজন আলাদা আলাদা ভাবে একটা রাতও কাটিয়েছে বলে মনে হয়না। সম্পর্কে দুজন মামাতো ফুপাত ভাই। নুরের মা ভালবেসে বিয়ে করে পাশের বাড়ির সেলিম মিয়াকে। আর তাই নানা বাড়ি আর দাদা বাড়ি বলতে কিছু নেই নুরের কাছে। সবই নিজের। আর আসাদের বাবারও বিয়েটা বোনের বিয়ের সমসময়েই হয়ছিল। আর দুই বাড়ির দুই প্রথম প্রদীপ হয়ে ছ’মাসের ব্যাবধানে জন্ম নেয় আসাদ ও নুর। তাই ছোট বেলা থেকেই দুই পরিবারের নয়নের মনি এই দুই মানিক জোড়। একসাথে বড় হওয়া, একসাথে কথা বলা, এক পাতে খাবার খাওয়া, একসাথে সাতার কাটা, এমনকি একসাথে সুন্নতে খৎনাও হয়েছিল দুজনের।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুজনের মাঝে বন্ধুত্বও জমে উঠেছিল সমান তালে। আর সাথে ছিল একে অন্যের জন্য অসম্ভব রকমের টান ও মায়া। নুর একটু বোকা টাইপের। খুব সরল। তেমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। অপরদিকে আসাদ খুবই বুদ্ধিমান ও চতুর। কিন্তু সে কখনোই নুরকে কোথাও ছোট হতে দিত না। তাই বাড়ির সবাই বলত, “আমাগো নুর যদি মাইয়া অইত, তইলে ওরে আসাদের লগেই বিয়া দিতাম।” তখন মুখ ফুলিয়ে নুর বলত, “এহ আমার আর খাইয়া দাইয়া কাম নাই। ওরে বিয়া করি আর ও আমারে দিন রাইত খালি মারুক।” আসাদ তখন বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলত, “আরে গাঁদা তর দোষের লিগা তর গায় অন্য কেউ জানি হাত না দেয়, হেল্লেইগা আমিই তোর বিচার করি। ক্যান পরে আবার তরে বাওড়ের তোন মোরকফুল আইন্না দেই না!” আর বাড়ির সবাই তখন সার্কাস দেখার মত হাসতে থাকে।

মোরকফুল নুরের খুব প্রিয়। ও কারো উপরে যতই রেগে থাকুক না কেন। একটা তরতাজা মোরকফুলই ওর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আসাদ ছাড়া আর কেউ যে ওর জন্য ফুল আনতে আধা মাইল হেটে হাঁটু কাদার বাঁওড় থেকে মোরকফুল আনবে না তা সে ভাল করেই জানে। আর তাই সে মাঝে মাঝে আসাদকে খাটানোর জন্য শুধু শুধু রাগের ভান করে থাকত। আর প্রিয় বন্ধুটির রাগ ভাঙ্গাতে আসাদ যখন আধা গায়ে কাদা মেখে ফুল নিয়ে আসত তখন নুর হো হো করে হাসত আর বলত, “তোরে ঢালী বাড়ির মাডি কাডা কেসসান গো মতন লাগতাছে।” আসাদের খুব রাগ হত তখন। মুখটা বাকা করে পুকুর ঘাটে যেতে যেতে বলত, “হ হ দেখমানে আমি যহন না থাকুম তহন কেডা তরে বাঁওড়ের তোন ফুল আইন্না দেয়।” কথাটা শুনে নুরের খুব খারাপ লাগত। কে জানে, হয়ত সে ভয় পেত। আসাদকে হারানোর ভয়। তাই পুকুর ঘাটে গিয়ে আসাদের হাঁটুতে পানি ঢালতে ঢালতে বলত, “কই যাবি তুই? তরে যাইতে দিলে তো। মাজায় দরি দিয়া বাইন্দা রাখুম তরে আমি।”

ছোট বেলা থেকেই আসাদ আর নুরের চলাফেরা দেখে গ্রামের সবাই অবাক হয়ে ভাবত এরা কি ভাই নাকি বন্ধু। নাকি দুটি দেহের মাঝেই একটি সত্তা। হিসেবটা মেলাতে পারতনা কেউ। হয়ত বর্তমান যুগ হলে অনেকেই এদের মধ্যকার সম্পর্কের নানা ব্যাখ্যা দিত। কিন্তু তখন কেউ এ নিয়ে ভাবত না। মানিক জোড় বলেই হেসে উড়িয়ে দিত। আর এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আসাদ নুরের কিশোর কাল। 

নুর লেখাপড়ায় দুর্বল ছিল। দিনরাত ভ্যা ভ্যা করে পড়লেও স্কুলে স্যারেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে হা করে তাকিয়ে থাকত। একদিন ক্লাসে স্যারের একটা প্রশ্নের উত্তর ভালভাবে না দিতে পারায় তাকে উত্তম মধ্যম পেতে হল। চোখের সামনে নুরকে শাস্তি পেতে দেখে আসাদের খুব কান্না পাচ্ছিল। নিউজপ্রিন্ট খাতা দিয়ে চোখ আড়াল করতে গেলে খাতাটার প্রথম পাতাটা ভিজে গেল। আর সহপাঠিরা তখন উচ্চস্বরে হেসে বলল, “দ্যাখ দ্যাখ বউ মাইর খায় আর জামাই বইয়া বইয়া কান্দে।” আত্বসম্মান বাচাতে চেপে গেল আসাদ। বাড়িতে এসে নুরের কি কান্না। আসাদ ওকে বুঝাতে গেলে আসাদকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, “ছারে তোরে ভাল কয়। তরে মারে না। আর কিছু অইলেই খালি আমারে মারে। আর তুই চাইয়া চাইয়া খালি দেহছ। দেখবি না ক্যা আমারে মারলে তো তোর বালই লাগে। আবার অহনে আইছে কলা করতে।” এই বলে আবারো তার কলের গান চালু। আসাদ তাকে শান্ত করার চেস্টা করলেও সে মানতে নারাজ। পরে আসাদ লুঙ্গি পড়ে বাড়ি থেকে বের হতে গেলে নুর তার হাতটা টেনে ধরে বলে, “অইছে এই কালি হাঝের সময় আর ফুল আনতে বাঁওড়ে যাওন লাগব না। আমার রাগ ভাইঙ্গা গেছে।” বলেই দাত বের করে হেসে ফেলে। আসাদ তখন মুচকি হেসে বলে, “আল্লায় যে তরে কোন মাডি দিয়া বানাইছে কে জানে।”
-আমি জানি। আমারে বানাইছে বাইল্লা মাডি দিয়া, আর তরে বানাইছে আডাইল্লা মাডি দিয়া। হেল্লাইগা আমি খালি ছুইড্ডা ছুইড্ডা যাই আর তুই আবার আমারে একখানে কইরা জোড়া দেস...
ওর কথা শুনে আসাদ হো হো করে হেসে উঠে। স্যার পরের দিনের জন্য একটা বাড়ির কাজ করতে দিয়েছিল। বলেছিল যে বাড়ির কাজ করে না আনবে তাকে জোড়া বেত দিয়ে পেটানো হবে। কিন্তু নুরের মাথায় এই গুলা ঢুকেই না। পরীক্ষাও দেয় আসাদের খাতা দেখে দেখে। সে কয়েক বার চেস্টা করেও বাড়ির কজের অংক গুলা মেলাতে পারছিল না। পড়ে আসাদ ওর কাছ থেকে খাতাটা টেনে নিয়ে বাড়ির কাজ করে দিল। বলল, “গাধা ছারেরে আবার কইছ না অংক আমি কইরা দিছি তইলে তরেও খাওব ছারে আমারেও খাইব।” 
-অইল কমু না। তুই করছোত বাড়ির কাজ?
-হ আমি তোর আগেই কইরা বইয়া রইছি। আমি কি তোর মতন গাধা নাকি!
-তুই যতদিন আছোত ততদিন আমার গাধা অইতে সমেস্যা নাই।
-আর যেইদিন আমি থাকমু না?
-ধুর বলদ আসাদ যদি না থাকে তাইলে নুর আবার থাকে ক্যামনে। তুই আছোত আমি আছি। তুই নাই আমিও নাই। 
-হ দ্যাখমানে, বড় অইয়া বিয়া কইরা মাইজ্জা কাকার মতন খালি বউর পাছে পাছে ঘুরবা। তহন কি আর আসাদের কতা মনে থাকব!
-এহ! আমি তরে ছারা থাকতে পারুম না। বউরে কমু মার লগে বিতরের ঘরে ঘুমাইতে। আর আমি তর লগে ঘুমামু বারিন্দায়।
-তইলে তর বউ যদি গোসা কইরা বাপের বাড়ি যায়গা?
-গ্যালে যাউকগা। তাতে আমার কি! আমার তুই থাকলেই অইব। আর ভাল কতা, তুই তো আমার বড়, তর বিয়া আগে অইব। তাই তুই নিজের চিন্তা কর। তুই পারবি আমারে ছারা থাকতে?
-ক্যান তুই কি রুপবান আর আমি কি তোর রহিম নি যে তরে ছারা থাকতে পারুম না!
-হ হেইয়া দেহা যাইব সময়কালে। অহন ঘুমা কুপী নিভাইয়া।

আর সাধারন দিন গুলোর মতই দুজনে জড়িয়ে ধরে ঘুমাল। এ যেন তাদের এক অভ্যাসের মতই হয়ে গেছে। একে অন্যের গলা না ধরলে ঘুমাতেই পারে না। পরদিন ক্লাসে স্যার যখন সবাইকে বাড়ির কাজ বের করতে বলল, তখন সবাই তাদের খাতা সামনে এগিয়ে দিল। স্যার একে একে দেখতে দেখতে যখন নুরের খাতা দেখল তখন সে বলল, “কি রে নুরা, আইজকা ভাবছিলাম বেত দুইডা তর পিডে ভাঙ্গমু। আর হেই ডরে তুই দেহি সব অংকই কইরা আনছোছ।”
-হ ছার। কাইলকা মাইর খাইয়া শিক্ষা অইয়া গ্যাছে আমার।
-ঠিক কইরা ক, অংক তুই করছোত নাকি কেউ কইরা দিছে?
-না না ছার আমিই করছি। আর কে কইরা দিব।
মুচকি হেসে স্যার খাতা দেখা চালিয়ে গেলে। কিছুক্ষন পরে স্যার দেখলেন একটা খাতায় অংকের শুধু ২টি লাইন লেখা। আর কিছুই নেই। স্যারের চোখ দুটো হ্যাজাক লাইটের মত জ্বলে উঠল। খাতার উপরে লেখা নাম দেখেই হাক ছাড়লেন,
-আসাদ...
মাথা নিচু করে দাঁড়াল আসাদ। এদিকে নুরের চোখও ছানাবড়া হয়ে গেল। মন মনে ভাবল, আসাদ না কইল ও আমার আগে করছে অংক... মাথা নিচু করে স্যারের দিকে এগিয়ে গেল আসাদ। স্যার রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-বাড়ির কাজ করস নাই ক্যান?
-ইয়ে... মানে... ছার... কাইল রাইতে মাথা ব্যাথা করতাছিল তাই ঘুমাই গেছিলাম। বাড়ির কাজ করতে পারি নাই।
-ও বুঝছি মাথা ব্যাথা ট্যাথা কিছু না। সব অইছে ফাকিবাজি।
এই বলেই স্যার আসাদকে বেত্রাঘাত করতে থাকলেন। ছোট্ট একটি শরীরের উপর আসাদ ডজন দুয়েক জোড়া বেতের আঘাত যে কতটা কস্টে সহ্য করছিল তা দেখে উপস্থিত প্রত্যেকেরই অন্তর কেপে উঠছিল। আর এদিকে নুরের কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল। আর কেউ না জানলেও সে জানে আজ আসাদের সব কষ্টের কারন সে। গতকাল সে মার খেয়েছিল, কিন্তু আসাদ খায়নি। তাই আসাদ আজ ওকে বাচিয়ে দিয়ে নিজে মুখ বুজে মার খাচ্ছে। শুধু নুরের সাথে সমান সমান করার জন্যে। আসাদ ওকে কতটা ভালবাসে তা আর বুঝতে একটুও বাকি ছিলনা নুরের। ডুকরে কেদে উঠল নুর। এদিকে হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল আসাদ। “আসাদ...” বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আসাদকে ধরল নুর। স্যার বললেন “অইছে অহন আর ঢং করন লাগবনা। এর পরে যদি কেউ ঠিকমত বাড়ির কাজ করে তারে আরো দশ বেত বেশি মারা অইব।”

সেদিন আর ক্লাস করতে পারলনা আসাদ। খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। তাই নুর ওকে নিয়ে স্কুল থেকে চলে এল। আসাদের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল তাই নুরের কাধে ভর দিয়ে হাঁটছিল। আর নুর এক হাতে চোখ মুছে আর অন্য হাতে আসাদকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এল। পথে নুর বলল,
-তুই আমার লগে মিছা কতা কইছিল কেন?
ভাঙ্গা গলায় আসাদ বলল, -কই আমি মিছা কতা কইলাম!
-তুই না কইলি তুই বাড়ির কাজ করছোত।
-হ করছি তো। তর খাতায় করলাম না!
-তাই বইল্লা আমারে বাচাইতে তুই নিজে মাইর খাইলি কেন?
-কাইল ছারে তরে আমার সামনে মারছে দেইখা আমার খুব খারাপ লাগছে রে। অনেক কষ্ট অইছে। তাই আইজ ইচ্ছা কইরাই আমি বাড়ির কাজ করি নাই। এহন আমি মাইর খাইছি, তুইও খাইছোত, সমান সমান...

আসাদের শেষ কথাটির মর্ম তখন হয়ত দুজনের কেউই বুঝেনি। তখন সেখানে কোন বুদ্ধিজীবী উপস্থিত থাকলে হয়ত সেও একে নিছক বাচ্চাদের কথা বলে হেসে উঠত। কিন্তু কেউ কখন কল্পনাও করত না যে এদের এই বন্ধুত্ব, এই ত্যাগ শেষমেশ কথায় গিয়ে থামবে। আসলে থামবে বললে ভুল হবে। কোন সম্পর্কই কখনো থেমে যায় না। শুধু কাল আর ক্ষনভেদে সম্পর্কের রূপ ও নাম পরিবর্তন হয়। আর আসাদ নুর ও সেদিন বুঝেনি তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা আসলে কি? শুধু জানত তারা এক জন অন্য জনকে ছাড়া একটা মুহুর্তও থাকতে পারে না। শুধু জানতে তারা এক অন্যকে খুশি করার জন্য যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত। শুধু জানত নুরকে একমাত্র আসাদই পারে পুরোপুরি আগলে রাখতে। আর নুরের এক চিলতে আনন্দের হাসিই যথেস্ট আসাদের সব ব্যাথা ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু এমন টা কেন হত, জানেনা তারা কেউই... কিন্তু এক সময় তারা জেনেছিল। হয়ত অনেকটা পরে... আবার হয়তবা এ সম্পর্কের মানে জানার সেটাই ছিল সঠিক সময়...

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মাধ্যমিক পরিক্ষায় পাশ করে দুজনেই। আর তাদেরকে ঢাকায় একটি সরকারি কলেজে ভর্তি করে দেয় আসাদের বাবা। কলেজের পাশেই একটি বাড়িতে ছোট্ট একটি রুম ভাড়া করে থাকে তারা। দুজনেই এখন টগবগে যৌবনদীপ্ত যুবক। এখনো তারা সেই আগের মতই এক সাথে ঘুমায়। একই খাটে। কিন্তু এখন আর আগের মত গলা ধরে ঘুমায় না। হয়ত এখন দুজনেই বুঝতে শিখেছে, তাই একটু ইতস্তত লাগে। কিন্তু এখনো দুজন দুজনকে আগের মতই দেখাশোনা করে। যেন দুজনের চাকরিই এটা, এক জন আরেক জনের দেখাশোনা করা আর পড়ালেখা করা। কিন্তু কখনো ভাবেনি যে আসলে তাদের মাঝে এত টান কেন? এত মায়া কেন? এর কারণটাও কখনো তারা জানত না যদি তাদের জীবনে শান্তা না আসত।

আসাদ দেখতে খুব সুন্দর ও স্মার্ট। আর সেই সুবাদেই এক সময় তার সাথে সম্পর্ক হয়ে যায় একই কলেজের ছাত্রী শান্তার সাথে। শান্তা বড়লোক ঘরের মেয়ে। তার সাথে প্রেম করার জন্য কলেজের হাজার ছেলে রাজি। কিন্তু এত জনের মাঝে শান্তা আসাদকেই কেন বেছে নিল? অন্য কাউকে কেন না... কে জানে এটাও হয়ত নিয়তির বিধান ছিল, তাকে তার গন্তব্যে পোছানোর রাস্তা দেখাতে...

শান্তার সাথে সম্পর্ক হবার পর থেকে আসাদ সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু শান্তাকে নিয়েই ভাবতে লাগল। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগল। আর এদিকে আসাদ যখন নুরকে জানাল শান্তার কথা, নুরের বুকের মধ্যে কেমন যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠল... আতকে উঠল সে... কেন জানি সে ততটা খুশি হতে পারলনা যতটা তার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কেন? তার ভাই ও সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি তার ভালবাসার মানুষকে খুজে পেল, এতে তো তারই সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু সে কেন চাইলেও খুশি হতে পারছেনা? কেন তার বুকের বামপাশটা অতি মাত্রায় কাপছে...? –এসব ভাবতে ভাবতে সেদিন আর ঘুমাতে পারলনা নুর। কিন্তু তার পরেও সে তার এই কেনর উত্তর খুজে পায়নি... 

দিন কয়েক পরে শান্তার সাথে যখন আসাদের প্রেম আরো জমে উঠল তখন আসাদ সব কিছু বাদ দিয়ে শান্তাকে নিয়েই সময় কাটাতে লাগল। ঠিক মত ঘরে থাকত না। ঠিক মত নুরের সাথে সময় কাটাত না। ঠিকমত ক্লাস করত না। প্রায়ই নুর ক্লাসের জানালা দিয়ে দেখত মাঠের কোনায় বসে আসাদ আর শান্তা চুটিয়ে গল্প করছে। আর এই দৃশ্য দেখে নুরের গাঁ জ্বালা করত। মুখ ঘুরিয়ে নিত অন্য দিকে। কিন্তু পরক্ষনেই আবার তাকিয়ে থাকত ওদের দিকে। কিন্তু বুঝতনা কেন তার এই দৃশ্য দেখতে অসহ্য লাগত। রাতে শুয়ে শুয়ে আসাদ যখন শান্তার গল্প বলত নুরের কাছে তখন নুরের মনে হত কেউ তার শত্রুর সুনাম করছে তার কাছে। কিন্তু কেন তার এমন মনে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে প্রতিদিনই ঘুম হারাম হয় নুরের।

এক শুক্রবার সকালে নুর বসে বসে পত্রিকা পড়ছিল। আসাদ তখনো ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ নুরের চোখ পড়ল একটা আর্টিকেলে। সেখানে পশ্চিমা কোন এক দেশের সমকামিতার বৈধতা দেয়ার প্রসঙ্গে অনেক কিছু ছিল। সাথে ছিল দুটি ছেলের ভালবাসার কথা। ছিল তাদের একে অন্যের প্রতি টান, মমতা ও ভালবাসার কথা। লেখাটি যেন কিছুটা নাড়া দিল নুরকে। সে চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল, “তাহলে আমি কি আসাদকে ভালবাসি? এই কারনেই কি আমি শান্তাকে মানতে পারিনা?” ভাবতে ভাবতে সে একবার আসাদের দিকে তাকাল। বিভোরে ঘুমোচ্ছে সে। আসাদের চেহারার দিকে তাকাতেই আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগতে লাগল নুরের। মনে হচ্ছিল সে যেন তার নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখছে আসাদের মাঝে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ তার মুখ থেকে অস্পস্ট ভাবে বেরিয়ে এল, “আসাদ আমি তোকে ভালবাসি...”
ঘুমথেকে উঠে আসাদও পত্রিকায় লেখাটি পড়ল। আর হাসতে হাসতে বলল, “নুরা দেখছোছ পাগলগো কারবার? পোলায় পোলায় বলে ভালোবাসা হয়... হা হা হা।”
-এত অবাক হওয়ার কি হইছে? আমরাও তো একে অপরকে ভালবাসি তাইনা...? (তাচ্ছিল্যের সুরে বলল নুর)
-ধুরো! আমাগো ভালবাসা আলাদা...
-হ... আসলেই আলাদা... (এড়িয়ে গেল নুর)

এদিকে নুর যতই আসাদ কে নিয়ে ভেবে ভেবে নিজেকে দুর্বল করছিল, অন্যদিকে আসাদও শান্তার সাথে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর ওদের সম্পর্ক এত দূর গিয়ে গড়াল যে তারা একসাথে রাত্রি যাপন করা শুরু করল। একদিকে আসাদ শান্তার সাথে রাত কাটায়, আর একদিকে নুর সারা রাত আসাদের অপেক্ষায় থেকে চোখের জলে বুক ভাসায়... কিন্তু কয়েকটা রাত শান্তার সাথে কাটানোর পড়ে আসাদ একটা জিনিস লক্ষ করল। সে শান্তাকে যতই কাছে টেনে নিক না কেন, তার পরেও তার কাছে কেন জানি কিসের অভাব বোধ হয়। কেন জানি মনে হতে থাকে নুরের কথা। শান্তার পাশে শুয়ে বার বার মনে হয় নুর কি করছে? ও কি ঘুমিয়েছে? কেন জানি শান্তাকে জড়িয়ে ধরার পরেও, নুরকে জড়িয়ে ধরার মত তৃপ্তি পায় না। এভাবে কিছুদিন নিজের মাঝে কথাটি নিয়ে গবেষনা করার পর আসাদ দেখল নিজের অজান্তেই সে দিন দিন শান্তার থেকে দূরে চলে আসছে... আর এক সময় মনে হতে লাগল শান্তাকে সে মনে হয় পরিপুর্নভাবে ভালবাসেনি কখনো। হঠাৎ তার মনে পড়ল সেদিনের পত্রিকা আর নুরের কথা। -তাহলে কি আমি নুরকে ভালবাসি? আমি কি সমকামী?... -না না এ কিভাবে হয়। -তাহলে আমি কেন শান্তাকে কাছে পেয়েও নুরকে বেশি মিস করি? কেন আমি শান্তার চেয়েও নুরকে বেশি অনুভব করি? কেন আমি শান্তার পাশে শুয়েও নুরের অভাববোধ করি?

এভাবে নিজের মাঝে যুদ্ধ করতে করতে কলেজের মাঠে গিয়ে পৌছল আসাদ। আর সেখানে গিয়েই সে যে দৃশ্য দেখল তা দেখার জন্য সে আসলেই প্রস্তুত ছিলনা। শান্তা আরেকটি ছেলের পাশে বসে তার হাত ধরে বকুল তলায় বসে মহানন্দে গল্প করছে। ঘটনাটি দেখে আসাদ কিছুটা বিস্মিত হলেও রেগে উঠতে পারল না। যেন সে মেনে নিয়েছে সবকিছু। কিন্তু কেন? সাথে সাথে সেখান থেকে সরে গেল আসাদ। আর নিজের মনের কাছেই প্রশ্ন করতে লাগল, “শান্তা আমার সামনে অন্য একজনের সাথে প্রেম করছে। আর আমি তা এভাবেই মেনে নিয়ে চলে এলাম? কেন?” আর সে নিজের অজান্তেই তার মনের উত্তর শুনতে পেল, “কারন আমি নুরকে ভালবাসি, শান্তাকে নয়।”

এরপর আর কাল বিলম্ব করলনা আসাদ। ছুটে গেল নুরের কাছে। নুরের সামনে গিয়ে অপলক দৃস্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। যেন সে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর মুখটিকে দেখছে... যেন এই মুখের মাঝেই তার সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে... নুর জিজ্ঞেস করল, “কিরে এমনে চাইয়া আছোস ক্যান?” ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই আসাদ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আমারে মাফ কইরা দে নুর। আমি তোরে ভালবাসি। অনেক অনেক ভালবাসি।
আসাদের কথা শুনে নুর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। ডুকরে কেদে উঠল। আসাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আমি তো হেই কবের তে তোর পথ চাইয়া আছি। কবে তুই আমার হইয়া আইবি। 
নুরের কপালে চুমু খেয়ে আসাদ বলল, -অহন তো আইছি... আর যামু না তরে থুইয়া। অহন থেইকা তরে আরো অনেক অনেক বেশি ভালবাসুম। কিন্তু একটা কতা, অহন কিন্তু তরে আর মোরকফুল আইন্না দিতে পারুম না...
নুর হেসে বলল, -আমার মোরকফুল লাগব না। আমার তুই থাকলেই হইব। আর কিছুর দরকার নাই আমার... 





আর এভাবেই দুজনের মধ্যকার সম্পর্কের নাম খুজে পেল আসাদ নুর। এ কোন সমকামীর জুটির সম্পর্ক নয়। এ সম্পর্ক ভালবাসার সম্পর্ক। যতটা ভালবাসলে আপনজনকে আরো আপন করে পাওয়া যায়, সেই ভালবাসার গল্প। এ কোন সাধারন প্রেম নয়... এ প্রেম আর দশটি অসাধারন প্রেমের মতই পবিত্র... ভালবাসা কখনই অপবিত্র হয়না। কারন অপবিত্র হলে তা ভালবাসাই হয়না। আর যে ভালবাসা হয়ে থাকে পবিত্রতার প্রতিটি অংশের প্রমান, সেই ভালবাসাই হয়ে যায় গল্প, কাব্য, আর সাহিত্যের শঙ্খ প্রেমের গল্প... 

♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥
অতি সল্প সময়ের মধ্যে লেখা এই গল্পটি... তাই লক্ষনীয় ভুল ত্রুটির জন্য সকলের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী...
♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?