তোমাকে ভালোবাসি, আরিয়ান!!!! বাস্তবে তো কোনদিন বলার সাহস বা সুযোগ কখনোই হয়ে ওঠে নি, ওঠবে না তাও জানি। কিন্তু মনে মনে, কল্পনায়, কত অসংখ্যবার যে চেঁচিয়ে বলেছি, ফিসফিসিয়ে বলেছি, তার হিসেব বোধ হয় স্বয়ং বিধাতাপুরুষের কাছেও নেই। কত অগণিত রাত বা দুপুরের ঘুমে ঢলে পড়ার আগে তোমায় ভেবে ভেবে কল্পনার আখ্যান রচেছি, কতভাবে তোমার সাথে খুনসুটি করেছি, তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়েছি, কিংবা হাউমাউ কেঁদেছি! মনেই হতো না যে আজ পর্যন্ত কখনো তোমার সাথে কোন কথাই বলা হয়ে ওঠেনি। কথা তো দূর, পরিচয়ই হয় নি এখনো! হবে এমন কোন সম্ভাবনাও বোধ হয় নেই। অথচ পাঁচ বছর ধরে তোমায় চিনি, ক্যাম্পাসের এখানে-ওখানে তোমার চলা-ফেরা, হাসি-কথোপকথন দেখি মুগ্ধ হয়ে, মাথা নিচু করে ফেলি কিংবা মুখ ঘুরিয়ে নিই আমার চোখে তোমার চোখ পড়লেই! প্রথম তোমাকে দেখি সেই ফার্স্ট ইয়ার-এ। তোমার ডিপার্টমেন্টের ফয়েজের বন্ধু মাহিন তোমায় দেখিয়ে আমায় বলেছিলো, “ঐ যে দেখো, ক্যামিকেলের ফার্স্ট বয়। দেখতেও অনেক সুন্দর, তাই না? বডি বিল্ডার। বাবা-মা খুব রক্ষণশীল। এই ছেলে ওর কাজিনের সাথে প্রেম করতো বলে বাবা-মা মেনে নেয় নি, এখন এই এত ভালো ছেলেটা সিগারেট খায়, কত স্টাইল করে, কি ছেলে কি হয়ে গেলো!” মাহিনের কণ্ঠে ছিলো স্পষ্টই আক্ষেপের সুর, তুমি ফার্স্ট বয় হয়েও সিগারেট খাও, ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারের ছেলে হয়েও নানানরকম স্টাইল করে ঘুরে বেড়াও – এতে বেচারা খুব হতাশ হয়েছিলো! ওর সব কথাই মোটামুটি এমন, এক্কেবারে বিশুদ্ধবাদী ছেলে ও। হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম ওর কথা শুনে। কিন্তু মনের কোণে, হাসির আড়ালে, একটু আক্ষেপ, অল্প একটু চিনচিনে ব্যাথা হামাগুঁড়ি দিয়েছিলো সে-ই প্রথম দিনই। অল্প একটু ভালো লাগাকে কেন্দ্র করে স্বপ্নের বীজ পুঁতলাম কখন, নিজেও টের পাই নি। তারপর তো অনেকগুলো দিন গড়ালো, সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে বছর বদলালো। কল্পনার ডালপালাও মেলতে লাগলো একটু একটু করে।কল্পনার বাইরে বাস্তবে, তোমার অনেক বন্ধুই আমার বন্ধু হলো, তুমি ছাড়া। আমার অনেক বন্ধুও তোমার বন্ধু হতে লাগলো, আমি ছাড়া। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে তোমার ছবি দেখি, তোমার বন্ধুদের মুখে জানতে পারি মডেলিং-এ দাপিয়ে বেড়াচ্ছো তুমি। পাঁচতারা হোটেল এ তোমার শো হয় বলেও শুনি। তোমার গুণের কথা এর-ওর মুখে আরো শোনা হয়। কিন্তু তোমার-আমার কথা বলা হয়ে ওঠে না কখনোই। দিন গড়াতেই থাকে স্বাভাবিক নিয়মে। আমিও আমার নিয়মে কল্পনার সাম্রাজ্য গড়তে থাকি, সংসার পাতি তোমায় নিয়ে। মনে মনে ভাবতে থাকি, ভীষণ বিষন্নতায় ভুগি যখন আমি, তখন তুমি কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলো, “কি হলো! এত মন খারাপ করলে চলে? বোকা ছেলে!” আমি কল্পনায় তোমার বুকে মাথা রেখে মুখ লুকিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ কাঁদি, “আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না!” আমার মাথার চুলে তোমার বলিষ্ঠ হাতের আদরমাখা আঙ্গুলগুলো ডুবিয়ে দিয়ে কানের কাছে ঠোঁট নামিয়ে ফিসফিসিয়ে তুমি বলো, “সোনামণি! তুমি মন খারাপ করো না! তাহলে যে আমারও খুব কষ্ট হয়!” আমার মন ভালো হয়ে যায়, বিষন্নতা এক ফুঁয়ে যেনো বহু বহু দূরে উড়ে সরে যায়, তোমার দরদমাখা স্বরে! দ্বিবাস্বপ্ন বাঁধ মানে না আমার। ভাবতে থাকি, আমায় নিয়ে তুমি অনেক দূর ঘুরতে যাও, কোন সবুজ গ্রামে। সারাপথ শক্ত করে ধরে রাখো আমার হাত, যেনো ছোট্ট ছেলে আমি। হারিয়ে যাবো তুমি আঁকড়ে ধরে না রাখলে।
আরো ভাবতে থাকি, সোনালী ভোরগুলোতে তোমার গলা জড়িয়ে ধরে আদিখ্যেতায় ভীষণ মেতে উঠি আমি। তুমি শান্ত হেসে আমায় প্রশ্রয় দাও, তারপর একসময় গালে-কপালে সজোর চুম্বনের ঝড় তুলে বিড়বিড় করতে থাকো, “আমার পাগলা বাবুটা! আমার সোনাজাদুমণিটা!” তোমার আদরে-প্রশ্রয়ে আমি ঘর কাঁপিয় খিকখিক হাসি, তারপর আরো শক্ত করে জাপটে ধরে বলি, “তোমাকে ছাড়া কোত্থাও যেতে আমার ভাল্লাগে না। ক্লাসেও না। কোত্থাও না”। তুমি আবারো আদুরে অভিভাবকের সুরে বলো, “জানপাখি! এটাই যে জীবন। সব তো মেনে নিতে হবে। আর তাছাড়া আমি তো সব-সময়ই তোমারই আছি। ভয় কিসের?” এভাবেই আদরে-আহ্লাদে, খুনসুটিতে দিন কাটতে থাকে আমাদের। সবই অবশ্য আমার কল্পনাতে। আর বাস্তবজীবনে তুমি-আমি অপরিচিতই থেকে যাই, দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নেয়া, কথা না বলে চলে যাওয়া, একই ব্যাচের ছেলে! তাতে আমার খুব একটা আফসোসও হয় না অবশ্য! বরং পরিচয়েই যতো ভয় আমার! যদি তুমি আমার কল্পনার মতো না হও! যদি বাস্তবতার সামনে আমার সুখ কল্পনা নিদারুণ অসহায়, নিরেট মিথ্যে বলে ধরা পড়ে যায়! যদি তুমিও আর সবার মতো ভীষণ ভাবে Homophobic হও, আমার ভালোবাসাকে ‘বিকৃত রুচি” বলে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে চলে যাও! এর চেয়ে বরং আমার কল্পনারা-ই ঢের ভালো! তোমাকে মনের মতো কল্পনা করে নিয়েই আমার সুখের দিন কাটতে থাকে। আর সেজন্যই, পরিচিত হওয়ার কোন ইচ্ছে, বা তাড়ন – কিছুই জাগে না আমার মনে। “একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি - তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী………” একবার আমরা সবাই, মানে ব্যাচের সবাই ঘুরতে গেলাম। তুমি ছিলে না সেখানে। ছিলো তোমার রুমমেট, যে ছিলো আমার রুমমেটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার মুখেই একদিন শুনলাম, “ আরিয়ান বলেছে, তুমি যেনো ওর কিছু ছবি তুলে দাও”। আকাশ থেকে পড়েছিলাম আমি! আমাকে চেনে? এই ছেলে আমায় চেনে? আমার নামও জানে? আরিয়ান চেনে আমায়?!! ওর মুখেই জানতে পেরেছিলাম, কিভাবে চিনলে আমায়, নাম জানলে কি করে। সুখের তীব্র একটি স্রোত আমার বুক তীব্রভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। সারাটি ক্ষণ সেই স্রোতে ভাসতে থাকি আমি, সাঁতার কাটি সুখের গাঙ্-এ। গাঙ্গের জলে রংধনুর ছায়া দেখি। কিন্তু তারপরও, কোনদিন আর কথা বলা হয়ে ওঠে না, ছবি তো বহুত দূর!! তবে রাস্তাঘাটে দেখা হলে চোরা চাহনি বিনিময় হয় এখন। আমি লক্ষ্য করি, আমায় হনহনিয়ে যেতে দেখলে ভীড়ের পথে তুমি কিছুটা পথ ছেড়ে দাঁড়াও, আমার জন্য! হয়তোবা এটুকুও আমার কল্পনা। হয়তোবা এটুকুও আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফসল, তুমি হয়তো ওমনি ওভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলে। কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে, অমন ভাবতে। আসলে আমার যে জীবন, তাতে কল্পনাদের মূল্য বাস্তবের চেয়ে কিছুমাত্র কম তো নয়। এমনকি, কল্পনা নিয়েই আমার বেঁচে থাকা। বাস্তব দুনিয়ায় খুব বেশি অধিকার বা দখল
– কোনটাই তেমন নেই আমার। বাস্তবতা আমার প্রতি খুব বেশি সদয় ছিলো না, কখনোই। তাই অতটা কল্পনাবিলাস নিয়ে আমার কখনোই আক্ষেপ হয় না। সুযোগ পেলেই কল্পনার অতলে ডুব দিই আমি। বাস্তবের চেয়ে ঢের আপন কল্পনার সে জগৎ। ভীষণ সুখি হয়ে এভাবেই কাটতে থাকে আমার দিন-রাত। এর মাঝেও আমি একবার ভুল করি। ভীষণ ভুল! প্রেমে পড়ি, আবারো। অন্য একজনের। এবং সেই প্রেম শুধুমাত্র কল্পনাতেই আবদ্ধ থাকে না। এবার কল্পনা আর বাস্তবে ভীষণ গুলিয়ে ফেলে বিষম গোল বাঁধাই আমি। তার সাথে মিশতে থাকি, হেঁটে বেড়াই, রিক্সায় চাপি, কথা বলি। তার ডাক শুনে পাগলপারা হয়ে ছুটে যাই, তাকে নিজের ভাবতে থাকি। ভাবি, এতদিনে বুঝি স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিলো। এতদিনে বুঝি প্রেম স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে নেমে এলো! এতদিন বাদে বুঝি শুধুই কল্পনায় ডুবে থাকার হাত থেকে নিস্তার মিললো। এতদিনে বোধ হয় আমার বাস্তবে ফেরার দিন হলো। কল্পনায় আরো ভীষণ বেপোরোয়া হই এবার। এবার শুধু কল্পনা নয়, রীতিমতো পরিকল্পনা করতে থাকি, জীবনকে নিয়ে। ভুলে যাই, অবাস্তব বলে যে একটা শব্দ আমার জীবনের সাথে সেঁটে আছে, আমার অভিধানে স্থায়ী আসন পেতে আছে। তাকে এতটাই নিজের ভাবতে থাকি যে, সে যে আমার মতোন নয়, সে যে একজন স্বাভাবিক মানুষ, সে যে একজন বিষমকামী মানুষ, সে যে কখনোই আমায় ভালোবাসতে পারে না – এসব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বসে থাকি আমি। তার প্রেমে নিত্য হাবুডুবু খেয়ে, কল্পনা-বাস্তবের ভীষণ দ্বন্দ্বের নিতান্ত অসহায় শিকার হয়ে বুক ভেঙ্গে কাঁদতে থাকি। বাস্তবে ফিরে এসে দেখি, ভীষণ বোকামীটাই করে ফেলেছি আমি! ভাবতে থাকি, এটা কি করলাম আমি? এটা কি হলো? এমন কেন হলো? কেউ আসে না, আমার কান্না মুছতে, আমার মাথা সবল বুকে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলতে, “ভালোবাসি! ভালোবাসি!” এই প্রথম টের পাই, বাস্তবতা কতোটা আলাদা! কতটা শক্ত! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমোতে যাই, কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। এই প্রথম বুঝতে পারি, কি ভীষণ ভুলই না করে ফেলেছি, কল্পনাকে বাস্তবে নামাতে চেয়ে! করার কিছুই থাকে না, ফুঁপানো, আর ক্রমাগত নিজেকে ঘৃণা করা ছাড়া। তাকে ভোলার আপ্রাণ চেষ্টাও চলতে থাকে সমানতালে। তাকে ভুলতে পারবো, এই আশায় আশেপাশের অন্য সুদর্শন-সুপুরুষদের নিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু বারবার তার চেহারাই কেবল ভেসে ওঠে, মনের চোখে। তোমার কথা ভুলে ছিলাম তখন, সেই ঘোরের মাঝে। দেখা হলেও দেখতাম না তোমায়। এবার আর ভান নয়, এবার সত্যিই খেয়াল করতাম না, তোমার উপস্থিতি। খুব কঠিন দুঃখও একসময় সয়ে যায়। দিন কাটতে থাকে। ক্ষতে প্রলেপ পড়তে থাকে, স্মৃতিতে পলি। তোমার সাথে দেখা হতে থাকে চায়ের দোকানে, ছোলা-মুড়ির ভ্যানের পাশে, হল-এর সামনের রাস্তায়, তড়িঘড়ি ছোট্ট গেইট পেরোতে গিয়ে হঠাৎ তোমায় দেখে হোঁচট খাই
– তোমার আমার মিলন ঐ পর্যন্তই। আবারও আমার চোখ পড়ে, মন পড়ে, তোমার উপর। অতদিনে আবারো আমার পূর্বপ্রেম চাগিয়ে ওঠে। আবার ভাবতে থাকি তোমায়, অবাক হয়ে দেখি, তোমায় ভাবলে আর তার চেহারা ভেসে ওঠে না মনের কোণে। বলতে পারো একরকম মুক্তি পেয়ে যাই আমি, তার স্মৃতি থেকে। তুমি হয়ে ওঠো আমার কল্পনার প্রেমলোকের আশ্রয়। তাকে ছেড়ে এবার তোমায় নিয়েই আবারো স্বপ্ন বুনতে থাকি। বোধ হয় আমি ভীষণ দুশ্চরিত্র বলেই। কি করবো বলো? যে জানে যে তার পক্ষে কখনোই প্রেম করা সম্ভব না, তার জীবনে কখনোই কোন সংসার আসবে না, কোন সন্তানের বাঁধন, কোন ভালোবাসার মালা তার গলায় জড়াবে না, সে বেচারা না হয় শুধু কল্পনা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক। সুখে থাকুক শুধু সুখস্বপ্ন দেখে দেখে। তোমরা, স্বাভাবিক মানুষেরা বাস্তবতা নিয়ে সুখী থাকো। বাস্তবতায় তোমাদের পুরো দখল থাকুক। আমার থাকুক কল্পনা।
আরো ভাবতে থাকি, সোনালী ভোরগুলোতে তোমার গলা জড়িয়ে ধরে আদিখ্যেতায় ভীষণ মেতে উঠি আমি। তুমি শান্ত হেসে আমায় প্রশ্রয় দাও, তারপর একসময় গালে-কপালে সজোর চুম্বনের ঝড় তুলে বিড়বিড় করতে থাকো, “আমার পাগলা বাবুটা! আমার সোনাজাদুমণিটা!” তোমার আদরে-প্রশ্রয়ে আমি ঘর কাঁপিয় খিকখিক হাসি, তারপর আরো শক্ত করে জাপটে ধরে বলি, “তোমাকে ছাড়া কোত্থাও যেতে আমার ভাল্লাগে না। ক্লাসেও না। কোত্থাও না”। তুমি আবারো আদুরে অভিভাবকের সুরে বলো, “জানপাখি! এটাই যে জীবন। সব তো মেনে নিতে হবে। আর তাছাড়া আমি তো সব-সময়ই তোমারই আছি। ভয় কিসের?” এভাবেই আদরে-আহ্লাদে, খুনসুটিতে দিন কাটতে থাকে আমাদের। সবই অবশ্য আমার কল্পনাতে। আর বাস্তবজীবনে তুমি-আমি অপরিচিতই থেকে যাই, দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নেয়া, কথা না বলে চলে যাওয়া, একই ব্যাচের ছেলে! তাতে আমার খুব একটা আফসোসও হয় না অবশ্য! বরং পরিচয়েই যতো ভয় আমার! যদি তুমি আমার কল্পনার মতো না হও! যদি বাস্তবতার সামনে আমার সুখ কল্পনা নিদারুণ অসহায়, নিরেট মিথ্যে বলে ধরা পড়ে যায়! যদি তুমিও আর সবার মতো ভীষণ ভাবে Homophobic হও, আমার ভালোবাসাকে ‘বিকৃত রুচি” বলে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে চলে যাও! এর চেয়ে বরং আমার কল্পনারা-ই ঢের ভালো! তোমাকে মনের মতো কল্পনা করে নিয়েই আমার সুখের দিন কাটতে থাকে। আর সেজন্যই, পরিচিত হওয়ার কোন ইচ্ছে, বা তাড়ন – কিছুই জাগে না আমার মনে। “একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি - তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী………” একবার আমরা সবাই, মানে ব্যাচের সবাই ঘুরতে গেলাম। তুমি ছিলে না সেখানে। ছিলো তোমার রুমমেট, যে ছিলো আমার রুমমেটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার মুখেই একদিন শুনলাম, “ আরিয়ান বলেছে, তুমি যেনো ওর কিছু ছবি তুলে দাও”। আকাশ থেকে পড়েছিলাম আমি! আমাকে চেনে? এই ছেলে আমায় চেনে? আমার নামও জানে? আরিয়ান চেনে আমায়?!! ওর মুখেই জানতে পেরেছিলাম, কিভাবে চিনলে আমায়, নাম জানলে কি করে। সুখের তীব্র একটি স্রোত আমার বুক তীব্রভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। সারাটি ক্ষণ সেই স্রোতে ভাসতে থাকি আমি, সাঁতার কাটি সুখের গাঙ্-এ। গাঙ্গের জলে রংধনুর ছায়া দেখি। কিন্তু তারপরও, কোনদিন আর কথা বলা হয়ে ওঠে না, ছবি তো বহুত দূর!! তবে রাস্তাঘাটে দেখা হলে চোরা চাহনি বিনিময় হয় এখন। আমি লক্ষ্য করি, আমায় হনহনিয়ে যেতে দেখলে ভীড়ের পথে তুমি কিছুটা পথ ছেড়ে দাঁড়াও, আমার জন্য! হয়তোবা এটুকুও আমার কল্পনা। হয়তোবা এটুকুও আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফসল, তুমি হয়তো ওমনি ওভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলে। কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে, অমন ভাবতে। আসলে আমার যে জীবন, তাতে কল্পনাদের মূল্য বাস্তবের চেয়ে কিছুমাত্র কম তো নয়। এমনকি, কল্পনা নিয়েই আমার বেঁচে থাকা। বাস্তব দুনিয়ায় খুব বেশি অধিকার বা দখল
– কোনটাই তেমন নেই আমার। বাস্তবতা আমার প্রতি খুব বেশি সদয় ছিলো না, কখনোই। তাই অতটা কল্পনাবিলাস নিয়ে আমার কখনোই আক্ষেপ হয় না। সুযোগ পেলেই কল্পনার অতলে ডুব দিই আমি। বাস্তবের চেয়ে ঢের আপন কল্পনার সে জগৎ। ভীষণ সুখি হয়ে এভাবেই কাটতে থাকে আমার দিন-রাত। এর মাঝেও আমি একবার ভুল করি। ভীষণ ভুল! প্রেমে পড়ি, আবারো। অন্য একজনের। এবং সেই প্রেম শুধুমাত্র কল্পনাতেই আবদ্ধ থাকে না। এবার কল্পনা আর বাস্তবে ভীষণ গুলিয়ে ফেলে বিষম গোল বাঁধাই আমি। তার সাথে মিশতে থাকি, হেঁটে বেড়াই, রিক্সায় চাপি, কথা বলি। তার ডাক শুনে পাগলপারা হয়ে ছুটে যাই, তাকে নিজের ভাবতে থাকি। ভাবি, এতদিনে বুঝি স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিলো। এতদিনে বুঝি প্রেম স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে নেমে এলো! এতদিন বাদে বুঝি শুধুই কল্পনায় ডুবে থাকার হাত থেকে নিস্তার মিললো। এতদিনে বোধ হয় আমার বাস্তবে ফেরার দিন হলো। কল্পনায় আরো ভীষণ বেপোরোয়া হই এবার। এবার শুধু কল্পনা নয়, রীতিমতো পরিকল্পনা করতে থাকি, জীবনকে নিয়ে। ভুলে যাই, অবাস্তব বলে যে একটা শব্দ আমার জীবনের সাথে সেঁটে আছে, আমার অভিধানে স্থায়ী আসন পেতে আছে। তাকে এতটাই নিজের ভাবতে থাকি যে, সে যে আমার মতোন নয়, সে যে একজন স্বাভাবিক মানুষ, সে যে একজন বিষমকামী মানুষ, সে যে কখনোই আমায় ভালোবাসতে পারে না – এসব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বসে থাকি আমি। তার প্রেমে নিত্য হাবুডুবু খেয়ে, কল্পনা-বাস্তবের ভীষণ দ্বন্দ্বের নিতান্ত অসহায় শিকার হয়ে বুক ভেঙ্গে কাঁদতে থাকি। বাস্তবে ফিরে এসে দেখি, ভীষণ বোকামীটাই করে ফেলেছি আমি! ভাবতে থাকি, এটা কি করলাম আমি? এটা কি হলো? এমন কেন হলো? কেউ আসে না, আমার কান্না মুছতে, আমার মাথা সবল বুকে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলতে, “ভালোবাসি! ভালোবাসি!” এই প্রথম টের পাই, বাস্তবতা কতোটা আলাদা! কতটা শক্ত! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমোতে যাই, কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। এই প্রথম বুঝতে পারি, কি ভীষণ ভুলই না করে ফেলেছি, কল্পনাকে বাস্তবে নামাতে চেয়ে! করার কিছুই থাকে না, ফুঁপানো, আর ক্রমাগত নিজেকে ঘৃণা করা ছাড়া। তাকে ভোলার আপ্রাণ চেষ্টাও চলতে থাকে সমানতালে। তাকে ভুলতে পারবো, এই আশায় আশেপাশের অন্য সুদর্শন-সুপুরুষদের নিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু বারবার তার চেহারাই কেবল ভেসে ওঠে, মনের চোখে। তোমার কথা ভুলে ছিলাম তখন, সেই ঘোরের মাঝে। দেখা হলেও দেখতাম না তোমায়। এবার আর ভান নয়, এবার সত্যিই খেয়াল করতাম না, তোমার উপস্থিতি। খুব কঠিন দুঃখও একসময় সয়ে যায়। দিন কাটতে থাকে। ক্ষতে প্রলেপ পড়তে থাকে, স্মৃতিতে পলি। তোমার সাথে দেখা হতে থাকে চায়ের দোকানে, ছোলা-মুড়ির ভ্যানের পাশে, হল-এর সামনের রাস্তায়, তড়িঘড়ি ছোট্ট গেইট পেরোতে গিয়ে হঠাৎ তোমায় দেখে হোঁচট খাই
– তোমার আমার মিলন ঐ পর্যন্তই। আবারও আমার চোখ পড়ে, মন পড়ে, তোমার উপর। অতদিনে আবারো আমার পূর্বপ্রেম চাগিয়ে ওঠে। আবার ভাবতে থাকি তোমায়, অবাক হয়ে দেখি, তোমায় ভাবলে আর তার চেহারা ভেসে ওঠে না মনের কোণে। বলতে পারো একরকম মুক্তি পেয়ে যাই আমি, তার স্মৃতি থেকে। তুমি হয়ে ওঠো আমার কল্পনার প্রেমলোকের আশ্রয়। তাকে ছেড়ে এবার তোমায় নিয়েই আবারো স্বপ্ন বুনতে থাকি। বোধ হয় আমি ভীষণ দুশ্চরিত্র বলেই। কি করবো বলো? যে জানে যে তার পক্ষে কখনোই প্রেম করা সম্ভব না, তার জীবনে কখনোই কোন সংসার আসবে না, কোন সন্তানের বাঁধন, কোন ভালোবাসার মালা তার গলায় জড়াবে না, সে বেচারা না হয় শুধু কল্পনা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক। সুখে থাকুক শুধু সুখস্বপ্ন দেখে দেখে। তোমরা, স্বাভাবিক মানুষেরা বাস্তবতা নিয়ে সুখী থাকো। বাস্তবতায় তোমাদের পুরো দখল থাকুক। আমার থাকুক কল্পনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন