১৮ আগস্ট, ২০১৪

বিবর্ণ স্মৃতির ক্যানভাস - ইরফান কাব্য

দু পাশে কাঁঠাল বাগান। বর্ষার শেষে শরতের
আগমনে আকাশে শুভ্র মেঘেরা দল বেধে ভেসে যাচ্ছে।
ঝিরি ঝিরি হালকা বৃষ্টি ধারায় কাঁঠাল বাগান এখনও সিক্ত। কেমন যেনো গুমোট মেরে আছে চারপাশ। বাগানের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া এক চিলতে কাঁচা মাটির পথ
ধরে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে অণু। গাঁয়ে হালকা তাঁতের
কালো পাঞ্জাবী, ব্লু জিন্স আর পায়ে স্লিপার । বৃষ্টি ভেজা বাতাসে ওর
ঠাণ্ডা লাগে,পাঞ্জাবীর দু পাশ দিয়ে জিন্স
প্যান্টের
পকেটে গুঁজে দিয়েছে হাত দুটি। আনমনে হেঁটে যাচ্ছে অণু আর কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর নিস্পলক চোখ দুটি। এক সময়
পাশের ঝিলে চোখ পড়তেই অণু থেমে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ঝিলের পাশে।এক
পলকে তাকিয়ে থাকে আর দেখে-'যে ঝিল বছর খানেক আগেও পানিতে থৈ থৈ করত, পদ্ম
জেগে থাকতো যার বুকে। আজ
সে শূন্য হয়ে আছে।
কাঁদা মাটিতে ভরে আছে কচুরি ফুল। দুটি হলুদ প্রজাপতি আজও
উড়ে বেড়াচ্ছে এ ফুলে ও ফুলে। পরিত্যক্ত
বাধানো ঘাটটি ঢেকে আছে ধূল আর ঝরা পাতায়।অনু সেইবার কত গল্পই না করছিলো স্বপ্নের সাথে এই ঘাটে বসে।
স্বপ্ন কি আর
বসে থাকার ছেলে! কখনও
ঘাস ফড়িং কিংবা প্রজাপতির পেছনে ছুটাছুটি, কখনও বা অদ্ভুত কিছু বলে নিজেই
হাঁসিতে ভেঙ্গে পড়ে হাত
পা ছুড়ে লাফালাফি। কখনও পরনের প্যান্টটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে নেমে পড়ে ঝিলের
পানিতে অণুর জন্য পদ্ম ফুল তুলতে। এই যে এত টুকু পথ অণু আজ একা হেঁটে এই ঘাট পর্যন্ত এলো,স্বপ্ন থাকলে তা কিছুতেই
পারতনা অণু। স্বপ্নের বামহাতটি শক্ত
করে ধরে হাটতে হত।নাহলে নির্ঘাত পিছলে পড়তো।কেননা অণু
ভেজা মাটিতে একদম
হাটতে পারতোনা। কিন্তু গত দুটি বছর কিভাবে ও এই
ভেজা মাটিতে হাঁটল তা ও নিজেও জানেনা।
... ... ...
পাঁচ বছর আগে স্বপ্নের
সাথে যেদিন অণুর প্রথম দেখা হয় সেই দিনটিও ছিল এমন, শরত কাল স্বপ্ন খুব ভালোবাসতো।খুব সকাল সকাল ওরা নির্দিষ্ট
স্থানে দেখা করে, হয়তো প্রথম দেখাতেই দুজন
দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিল,তাই স্বপ্ন প্রথম দিনেই
অণুকে নিয়ে চলে আসে তার সব থেকে পছন্দের স্থানে। অবশ্য এর পুরো জমিটাই ছিল স্বপ্নদের নিজস্ব মালিকানা।পাশেই ওদের বাড়ি। মা বাবার একটি মাত্র ছেলে স্বপ্ন। বড় একটি বোনও ছিল ওর। তবে তার বোনকে বিয়ে করে ভগ্নীপতি পাড়ি জমায়
কানাডায়। বাবা মার সব টুকু আদর তখন একাই ভোগ করত স্বপ্ন। তবে ওর বাড়ি শহরের থেকে একটু দূরে হওয়াই স্বপ্ন ওর ভার্সিটির
কাছে একটি ছোট
বাসা নিয়ে থাকতো । সময় পেলেই দৌড় দিত বাড়িতে বাবা মার আদরের লোভে। কিন্তু
অণুকে পাওয়ার পর আর
একা যেতনা। সাথে নিয়ে যেত অণুকেও। আর দুজন
ঘুরতে ঘুরতে চলে আসতো এই কাঁঠাল বাগানে। এখানে আসলেই স্বপ্ন কেমন যেন বদলে যেত,এমনিতেই স্বপ্ন একটু বেশী দুষ্ট প্রকৃতির ছিল, মা বাবার আদরের বাদর বলে কথা। তবে এই সময়টা স্বপ্ন একটু বেশীই চঞ্চল হয়ে যেত। মুগ্ধ নয়নে অণু শুধু স্বপ্নের দিকেই
তাকিয়ে থাকতো তখন। হঠাত স্বপ্নের ঠোঁটের স্পর্শে অণুর ঘোর ভাঙত।
তখন স্বপ্ন জিজ্ঞেস করত-"কি দেখছ এমন করে?"
অণু বলত -"তোমায় দেখছি,
দেখছি আমার দুষ্ট
বাবুটা আর কত
দুষ্টমি করতে পারে!"
এটা শুনে স্বপ্ন যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলত- " ওই
ভাবে দেখনা! ওই চোখে একবার হারিয়ে গেলে আর
খুঁজে পাবেনা কিন্তু আমায়।" অণু এইবার একটু রেগে যায়, অভিমান করে একটু বকে দেয় স্বপ্নকে-"এইভাবে বলবে না। দিন দিন বেশী বাদর হয়ে যাচ্ছ।
যা মুখে আসে তাই বল!"
স্বপ্ন বলে- "হ্যাঁ!আমি তো বাদর ই ! তোমার
দুষ্ট বাদর ... এত আদর দিয়েই তো এমন বাদর বানিয়েছ আমায়!"
এটা বলে হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ে স্বপ্ন।
হাসতে হাসতে এক সময় অণুকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকায়। খানিক পর মুখ তুলে অণুর গলায় চুমু খায় স্বপ্ন,অণুও আদর দিয়ে দেয় স্বপ্নের কপালে।
এইভাবে যখন
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তখন বাবুই পাখী দুটি একে অন্যের ডানায় ভর করে নীড়ে ফিরে যায়।
... ... ...
বেশ যাচ্ছিলো অণু স্বপ্নের দিনগুলি। প্রতিদিন দেখা করা,
ঘুরে বেড়ান,হাসি ঠাট্টা,মান- অভিমান, কখনও
কখনও তুমুল ঝগড়ার পর
একে অন্যকে জড়িয়ে কান্না করা আর ভালোবাসার ঢেউয়ে একে অন্যের গভীরে হারিয়ে যাওয়া। সব কিছুই ছিল ঘোরের মত ।
অণুর সেই ঘোর
ভাঙল একদিন সকালে রিওনের ফোন পেয়ে। অণু দৌড়ে গেল রিওনের কাছে। রিওন
দাড়িয়ে আছে হসপিটালের তৃতীয় তালার বারান্দায়। কোন
কথা না বলেই রিওন অণুর হাত ধরে ছুটতে লাগলো। ওর চোখ অশ্রু ভেজা। অণু কিছুই
বুঝতে পারছে যে রিওন
আসলে কি করছে।
রিওন স্বপ্নের বেস্টফ্রেন্ড। মেডিকেল কলেজে পড়ে। প্রথম দেখাতেই যে রিওন অণুর
মাঝে হারিয়েছিল,তা অণু ভালই বুঝে গিয়েছিল।
স্বপ্নও হয়তো বুঝেছিল কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে দুজনেই চেপে গিয়েছিল। আর রিওনও কখনও তা প্রকাশ করেনি। অণু আর স্বপ্নের ভালোবাসার
আড়ালে হয়তো গুমরে কেঁদেছে রিওন। তবুও কখনও হাত
বাড়ায়নি বেস্টফ্রেন্ডের প্রেমিকের দিকে।
রিওন অণুকে নিয়ে একটি রুমের সামনে এসে দাঁড়াল আর বলল- "ভিতরে যাও । "
অণু তখনও
বুঝতে পারছিল না কি হতে যাচ্ছে। সে অবুঝ বাচ্চার মত রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল আর
যা দেখল,তার জন্য অণু
একদমই প্রস্তুত ছিলোনা। স্বপ্নের
মা বাবা দুজনেই
চেপে চেপে কান্না করছেন।স্বপ্ন কে অক্সিজেন আর স্যালাইন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।অণু ভেতরে ঢুকতেই স্বপ্নের
মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন ।এরপর অণু যা জানতে পেল তাতে যেন ওর পায়ের নীচের মাটি সরে গেলো।
একি শুনছে অণু !
এর জন্য কি স্বপ্ন মাথার যন্ত্রণায় চিৎকার করত?
এটা জানার পরেই কি স্বপ্ন তার অণুকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল? তাকে ছাড়া তার
অণুকে বাঁচতে শেখাতে চেয়েছিল? . . . . .হাঁয় ঈশ্বর !
অণু তার স্বপ্নকে নিয়ে তখন উল্টাপাল্টা কত
কিছুই না ভেবেছিলো। তার স্বপ্ন যে ব্রেন ক্যান্সারের
মতো মরণব্যাধিতে এতটা দিন ভুগছিল তা একটি বারের জন্যেও অণু বুঝতে পারেনি ।
কেমন
ভালবাসলো স্বপ্নকে সে!
অণু কিছু
ভাবতে পারেনা, হাঁটু
ভেঙে বসে পড়ে সেখানেই।
... ... ...
জানালা দিয়ে সূর্যের
আলো এসে পড়েছে ঘরে । বিছানায় ঘুমন্ত স্বপ্নকে এক নিষ্পাপ শিশুর মতো লাগছে। তবে বেশ
শুকিয়ে গেছে স্বপ্ন এই কয়দিনে। চোখের নীচে পড়েছে কালো ছোপ । ওদের এই তিন বছরের এক সাথে পথ চলায়
অণু একবারের জন্যও
ভাবতে পারেনি যে তার স্বপ্নের এই অসহায় রূপ
ওকে দেখতে হবে কোনদিন ।
ঘুম
ভেঙে স্বপ্ন অণুকে জিজ্ঞেস করল "সারারাত ঘুমাও নি, তাই না অণু ?" অণু কিছু বলে না, শুধু স্বপ্নের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে-এই কি তার সেই স্বপ্ন যে ছিল দুরন্ত ছটফটে দুষ্টের শিরোমণি? যে একাই
মাতিয়ে রাখতো সারা পৃথিবী! সকলের আদরের সেই ছেলেটি আজ এমন হয়ে গেল কেন? কেন আজ ও এত শান্ত হয়ে এইভাবে বিছানায় শুয়ে আছে ? কেন ও আর আগের
মতো ছুটোছুটি করছে না ? কেন ও চার দিক কাঁপিয়ে ওর
হাসিতে ভরে দিচ্ছে না । কেন আজ ও এমন হয়ে গেল? ... কেন?
স্বপ্ন অণুর হাতটা ধরে ওকে বলল- "জানো অণু? আজ অনেক দিন হল জানালার ওপাশ টা দেখা হয়না। নেওয়া হয়না সূর্যের কোমল আদর।দিন রাত সবই যেন এক
হয়ে গেছে আমার জন্য। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি দেখি। আচ্ছা অণু?আমি কি আবার আলোর স্পর্শ নিতে নিতে পারব?আগের মত ছুটোছুটি করতে পারব ? খুব ইচ্ছা করছে মুক্ত পাখীর
মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে।ঐ আলোর মায়া আজ আমাকে খুব টানছে।"
কথা গুলো শুনতে শুনতে অণুর চোখ ভিজে এলো । নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলনা।তাই রুম থেকে বের হয়ে আসলো,দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগলো।
সে জানে স্বপ্নের এই অদম্য ইচ্ছা আর আশা গুলো কখনই আর সত্য হবার নয়। ডাক্তাররা কোন ভরসা দেননি ।অণু
তখনি বুঝে গিয়েছিলো যে স্বপ্ন আর তার স্বপ্নরাজ্যে থাকবেনা , অণু অণু বলে আর
কোন দুষ্টামি পাগলামি করবেনা, রাগ করে আর
অণুকে বকাবকি করবেনা , ভীষণ অভিমানে অণুর বুকে মুখ লুকীয়ে আর কাঁদবেনা। ভালোবাসার অভিযোগ শেষে- " তুমি এত পঁচা কেন? " বলে অণুর
ঠোঁটে আর চুমু খাবেনা । অবুঝ শিশুর মতো কোন ভুল করে শেষে অণুর কাছে এসে নিজের কান
ধরে বলবেনা - "sorry বাবা ! আর এমন হবেনা । এই দেখো কান ধরেছি । এইবার তো ক্ষমা কর please!"
অণুর কষ্টের দিনে আর কেউ শক্ত করে তার হাতটি ধরে রাখবেনা। এই তিনটি বছরে ওরা দুজন সাজিয়েছে অণু স্বপ্নের ভালোবাসার ভুবন কিন্তু কখনও কেউ কাউকে বলেনি "ভলোবাসি"
হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব করেছে ওরা , চোখের
দিকে তাকিয়ে পড়ে নিয়েছে মনের সব কথা।
কি অদ্ভুত তাই না ?
এত
ভালোবেসেও কেউ কখনও
কাউকে "ভালোবাসি" শব্দটা বলার প্রয়োজনবোধ করেনি,এটাই হয়তো প্রকৃত ভালোবাসা! যা কোন ধ্বনি, শব্দ, বাক্য বা ভাষায় বলে বুঝাতে হয়না , কিছু না বলেই সব জেনে নেওয়া যায়। অণু ভাবেনি যে এই পরম উষ্ণ ভালোবাসার
ভালোবাসি শব্দটি সে স্বপ্নের মুখে প্রথম আর শেষ বারের মতো শুনবে।
তখন মধ্যরাত!
স্বপ্নের অবস্থা আজ দুপুর থেকেই খারাপ
মনে হচ্ছে। বাইরে স্বপ্নর মা বাবা আর রিওন সৃষ্টিকর্তাকে এক
মনে ডেকে যাচ্ছে। অণু তার স্বপ্নের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,
নিজের ভালোবাসাকে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে দেখে মাঝে মাঝে ওর ভেতরটা কষ্ট আর কান্নায় ফেটে যাচ্ছে। তবু
সে নিজেকে অনেক
কষ্টে সামলে রাখছে, আর যায় হোক স্বপ্নের সামনে কিছুতেই কান্না করা যাবে না। এতে স্বপ্ন আরও ভেঙে পড়বে।
এক সময় স্বপ্ন অণুকে বলল- "অণু আমাকে একটু আদর করে দাও না ! " অণুর চোখ ভিজে এলো, ও স্বপ্নের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল - "আমার দুষ্ট বাবু টা"
স্বপ্ন যেন আজ অনুভূতিহীন,মুখে অতি কষ্টে একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে আবার বলল -
"আচ্ছা অণু,আমাকে একটা কবিতা শুনাও
না plz! ঐ যে আমার খুব পছন্দের কবিতাটি, খুব ইচ্ছা করছে তোমার কণ্ঠে শুনতে। কত দিন তোমার কণ্ঠে কবিতা শুনা হয়না, শুনাবে plz?"
অণু কিছু না বলেই শুরু
করে-
"আলোকের স্মৃতি,
ছায়া বুকে রাখি ছবি বলি কাকে? তুমি কি কেবলই ছবি,
আমার শুধু
পটে লিখা ... !
ঐ যে নীহারিকা,
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়ে ,
আলো হাতে চলিয়াছে
আঁধারের যাত্রী... "
বলতে বলতে অণুরগলা ধরে আসছে, অণু খেয়াল করল স্বপ্ন এক দৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ ছলছল করছে।
কবিতা শেষ,স্বপ্ন চোখ বন্ধ করল। ওর চোখ গলে গাল
বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অণু স্বপ্নের মাথাটা নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে ওর
জলে ভেজা চোখে চুমু খেল। তখন অণু শুনতে পেল স্বপ্ন খুব মৃদু কণ্ঠে বলছে -" ভালোবাসি"
শুধু একবার।
তারপর আর কিছু নয় । সব যেন থেমে গেল। ডাক্তার নার্স সবাই এসে স্বপ্নকে নিয়ে যাচ্ছে। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। সাথে রিওনও দৌড়াচ্ছে।
অণু স্বপ্নের
হাতটা ধরেছিল শেষ পর্যন্ত যতক্ষণ সবাই স্বপ্নকে কাঁচের দেয়ালের ওপাশে নিয়ে যায়।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অণুকে ছাড়তে হল তার
ভালোবাসার হাত। নিজের অজান্তেই বলে উঠলো -"খুব ভালোবাসি"
কিন্তু যাকে বলল সেই স্বপ্নই তা শুনতে পেলনা। হায়রে ভালোবাসা!
... ... ...
কাঁচের দেয়ালের
ওপাশে দাড়িয়ে অণু।
দেখছে কিভাবে তার স্বপ্ন আবছা আঁধারে শুয়ে আছে। এই আঁধার ও খুব ভয় পেত ।
কাঁচের দেয়ালে অণু হাত রেখে বলল- "আমি জানি, তুমি ভয় পাচ্ছ স্বপ্ন। একা আঁধারে তুমি অনেক ভয় পাও ।এই যে দেখ,আমি দাড়িয়ে আছি এখানে। কোন
ভয় নেয় তোমার. . ."
কিন্তু ততক্ষণে স্বপ্ন আর নেই। বিদায়
নিয়েছে চিরতরে।দেয়ালের ওপাশ থেকে নিথর
পড়ে থাকা স্বপ্নকে দেখে দেখে কেঁদে যাচ্ছে অনু!
এমন সময় অণুর কাঁধে হাত রাখল কেউ ............... অণু
তাকিয়ে দেখে যে ওটা ............
... ... ...
ফোন বাজছে।
অণুর ঘোর কাটল।
ফোনে থাকিয়ে দেখল রিওন কল দিয়েছে।
স্বপ্নকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে বিকাল
গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে তার কোন খেয়াল নেই অণুর।
ফোন পিক
করে অণু বলল - "হ্যাঁ, রিওন বলো!" ওপাশ থেকে রিওন বলল- "কোথায় তুমি অণু ?আন্টি বলল সেই সকালে নাকি কিছু না খেয়ে বের হয়ে গিয়েছ। সারাদিন আর কোন খবরই নেয়। ফোনেও পাচ্ছিলাম না তোমায়। এতক্ষণ পর পেলাম।" অণু বলল - "রিওন! তুমি হয়তো ব্যস্ততার জন্য ভুলে গেছ, আজ স্বপ্নর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী" -
কথাটা বলতে গিয়ে অণুর
গলা ধরে এলো।
রিওন বুঝতে পেরে -" আমি আসছি" - বলেই
ফোনটা রেখে দিল। কারণ ও জানে আজ অণু কোথায় থাকবে। এই
কাঁঠাল বাগানেই দুই বছর আগে অণু নিজের হাতে তার ভালোবাসার মানুষটির কবরে মাটি দিয়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সেইদিন। রিওন তখন ওকে সামলেছে। স্বপ্নর
মৃত্যুর দিন সেই রিওন-ই ওর কাঁধে হাত রেখেছিল। আর আজ অবধি সেই অণুর পাশে ছায়া হয়ে চলছে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে স্বপ্ন যে তার অণুকে সেই রিওনের কাছেই রেখে গিয়েছিলো। কারণ স্বপ্ন জানতো ওর পরে এই রিওনই তার অণুকে সব
চেয়ে বেশী ভালবাসতে পারবে। তার ভালোবাসার অণুকে এই পৃথিবীতে একা করে দিয়ে চলে যেতে চায়নি বলেই
হয়তো স্বপ্ন তা করেছিল ... অণুর হাত সঁপেছিল রিওনের হাতে ...
... ... ...
কিছুক্ষণের মাঝেই রিওন
চলে এলো নিজের গাড়ী চালিয়ে। তাই আসতে বেশী সময় লাগেনি। আজ ও অনেক বড় ডাক্তার।
গাড়ী বাড়ি টাকা পয়সার কোন অভাব নেই ওর।
রিওন এসে অণুকে বলল- "চল!"
ওর হাতে অজস্র অপরাজিতা। অণু
দেখেই বুঝতে পারল যে রিওন ভুলেনি তার বন্ধুর মৃত্যুর দিনটির কথা। নাহলে এত অল্প সময়ে এত গুলো অপরাজিতা ও
কিভাবে নিয়ে আসলো!
এইগুলো আগেই
হয়তো আনিয়ে রেখেছিলো । সারাদিন এত এত অসুস্থ মানুষের সেবা করেও শেষ বেলায় ক্লান্ত দেহে ছুটে এসেছে বন্ধুর কবরে বন্ধুর প্রিয় ফুল অপরাজিতা দিয়ে ওর প্রতি নিঃসীম
ভালোবাসা জানাতে। স্বপ্নের কবরের পাশে বসে অণু আর রিওন
দুজনেই নীরবে চোখের জল ফেললো। অণুর গাল বেয়ে দু ফোটা অশ্রু বিন্দু ঝরে পড়ল স্বপ্নর কবরে।
অণু
মনে মনে বলল - "আমার পাশে আজ তুমি নেই ,
আছে রিওন,আমি জানি রিওন আমাকে অনেক
ভালবাসে। কিন্তু আমি ...!
আমি হয়তো ঐভাবে ওকে কক্ষনই ভালবাসতে পারবনা,
যেভাবে তোমায়
ভালোবাসে ছিলাম , আজও
বাসি আর আজীবন বাসবো। কিন্তু তুমি তোমার ভালোবাসাকে যার কাছে রেখে গেছ
তাকে আমি কখনও কষ্ট দিবনা ... !" আর ওদিকে রিওনও জানে যে অণু কখনও
ওইভাবে ওকে ভালবাসতে পারবেনা। তবু সে তার নিজের
মতো করে অণুকে ভালোবেসে যায়, অণুর সব সুখ দুঃখ নিজের
মনে করে ভাগাভাগি করে নেয়। বিনিময়ে কোন প্রত্যাশা রাখেনা। কেননা ও জানে যে এই ভালোবাসা তো ওর নয়। এই ভালোবাসা অণু স্বপ্নের ভালোবাসা।
... ...
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
রিওন ড্রাইভ করছে। অণু জানালার দিকে বাইরে তাকিয়ে আছে । গাড়ীতে উঠার আগে অনেক কেঁদেছে অণু। বাগানের অদূরে তাকিয়ে ছিল স্বপ্নদের বাড়ির দিকে। যেখানে অণু আর স্বপ্নের সব চেয়ে মধুর সময় গুলো কেটেছিল। আজ ঐ
বাড়িতে ধূল দেবারও কেউ নেই। ছেলের মৃত্যুর শোকে স্বপ্নর মা বছরের মাথায় মারা যায়।নিঃস্ব বাবাকে তাই নিয়ে যায়
তার কানাডা বসবাসরত মেয়ে, স্বপ্নের বড় বোন। ঐ বাড়ি আজ শুন্য । আর স্বপ্ন আজ ঘুমিয়ে আছে এই কাঁঠাল বাগানে অন্ধকারে একা। কথাটা ভাবতেই অণু আবার কেঁদে ফেললো, সে তার স্বপ্নকে একা আঁধারে ফেলে চলে এসেছে।
তার বাবুটা হয়তো খুব ভয় পাচ্ছে,কিন্তু আজ তো সে নির্বাক, তাই
হয়তো কিছুই বলতে পারছেনা- "অণু আমায় এই
অন্ধকারে একা রেখে যেও
না plz,আমার খুব ভয় লাগে ! "
... ... ...
গাড়ী চলছে সোঁ সোঁ করে। ফাকা রাস্তা চারপাশ অন্ধকার। আজ আর ওরা বাড়ি ফিরবেনা । দুজনেই নীরব,কারো মুখে কোন কথা নেই। রিওন তার ভালোবাসার অণুকে পেয়েও কত দূরে তাদের অবস্থান। পেয়েও না পাওয়ার কষ্টে পুড়ছে প্রতিটা ক্ষন। আর অণু!!
সীমাহীন
ভলোবাসা পেয়েছে জীবনে । স্বপ্ন
ওকে চিনিয়েছে ভালোবাসা স্বর্গ কাকে বলে !ও চলে যাওয়ার পরেও ভালোবাসা পেয়েছে রিওনের থেকে । এত ভালোবাসা পেয়েও আজ অণু একা।
এই কি তবে নিয়তির বিধান ?
সব ভালোবাসাই
কি রয়ে যাবে অতৃপ্ত !
সব প্রেমীর বুক থেকেই
কি বেরিয়ে আসবে এমন নিঃশব্দ আর্তনাদ আর নীরব হাহাকার।

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?