০৩ মার্চ, ২০১৪

ভালোবাসা হারিয়ে খুঁজি ( পর্ব - ৩ )


শিমুলের মন খুব খারাপ। রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় ফিরছে তারা। শিমুল গাড়ি ড্রাইভ করছে। শুভ্র সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, তার নাকি মাথা খুব ব্যাথা করছে। শিমুল শুভ্র কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছিলো রাতের ডিনারের জন্য। রান্নার ঝামেলা করতে তার একদম ভাল লাগে না, দুপুরে কোন রকম খিচুড়ি রান্না করেছে, ফ্রিজে গরুর মাংস ছিল, তাই দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। শুভ্র আসার আগে বুয়াই সব রান্না করে দিয়ে যেত। কিন্তু বুয়ার রান্না শুভ্রর একদম ভাল লাগে না। তাই সে এসেই বুয়াকে পার্মানেন্ট ছুটি দিয়েছে। সংসারে রান্না থেকে শুরু করে ঘর গোছানো সহ সব কাজ শুভ্র নিজেই করে কিন্তু প্রতি শুক্রবার শিমুলের কাধে দায়িত্ব পড়ে, আর ঐ একদিনেই শিমুলের অবস্থা কাহিল।

নিজেদের কথা ভাবলে অদ্ভুত লাগে শিমুলের। ভালোবাসাহীন, সম্পর্কহীন একটা সংসার যেখানে এক ছাদের নীচে বাস করেও পরষ্পর থেকে তারা কতটা দূরে, একসাথে থেকেও তারা দুজনই একা। শুভ্র চাইলেই সব কিছুর একটা নতুন সূচনা হতে পারে, কিন্তু শুভ্র কি কখনো তা চাইবে? শিমুল কি পারবে শুভ্রর মনে নিজের জন্য কিছুটা হলেও জায়গা করে নিতে?
এসব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল শিমুল, এমন সময় দৈত্যের মত একটা ট্রাক সামনে থেকে বাতাস কাঁপিয়ে আসছিল, আর একটু দেরি হলেই লেগে যেত শিমুলের গাড়ির সাথে।

- দেখে চালাও না, এক্সিডেন্ট করবে তো, শুভ্র চোখ খুলে বললো।
- না, একটা ট্রাক হঠাৎ করে সামনে চলে আসলো।
- তুমি না আমাকে কি যেন বলবে বলেছিলে?
- হ্যা, তোমাকে বলা হয়নি, এই বুধবার সায়ানের জন্মদিন, এবার একটু বড় করেই অনুষ্ঠান করছে, মা খুব ধরেছে আমাকে যাওয়ার জন্য, না গেলে অনেক রাগ করবে।
- কিন্তু ছুটি পাবে অফিস থেকে?
-হ্যাঁ, বসকে বলেছি, ম্যানেজ হয়ে যাবে, তাছাড়া কতো দিন মাকে দেখি না, বাসার সবার জন্যই খারাপ লাগছে।
- ঠিক আছে, যাও তাহলে।
- তুমি একা থাকবে?
- কেন, সমস্যা কি?
- শুভ্র, আমি চাইছি তুমিও আমার সাথে চট্টগ্রাম যাও।
- আমি? আমি কিভাবে যাব?
- কেন, সমস্যা কথায়?
- সবাই কি মনে করবে?
- তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমার সাথে যেতেই পার, তাছাড়া আমি মাকে তোমার কথা বলেছি, মা বলেছেন তোমাকে সহ নিয়ে যেতে।
- তুমি বুঝতে পারছো না, আদিত্য এখন চট্টগ্রামে, সে হয়তো জানে যে তুমি আর আমি এখন একসাথে আছি, সে তো আর জানে না যে আমরা দুজন শুধু বন্ধু।
- গাধার মত কথা বল না, আদিত্য বিয়ে করে বৌ নিয়ে সংসার করছে। তুমি এখন যার সাথে যা খুশী তাই কর, তাতে তার কি এসে যায়?

- যদি আদিত্যের সাথে দেখা হয়ে যায়?
-ওকে, তোমাকে যেতে হবে না, আমি একাই যাব।
শুভ্র কিছু না বলে চুপ করে রইলো। শুভ্রকে আরও কিছু কথা বলার ছিল শিমুলের, কিন্তু এখন আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। তার অর্থহীন কথা গুলো হয়তো কখনোই বলা হবে না।
তার খুব ইচ্ছে করে শুভ্র কে নিয়ে সমুদ্রে যেতে, সমুদ্রের তীর ঘেষে শুভ্রর হাত ধরে হারিয়ে যেতে নীল অজানায়, সাগরের ঢেউ গুলো তাদের পায়ে এসে আছড়ে পড়বে, সূর্যাস্তের পর গোধূলি বেলায় পাথরের উপর বসে গল্প করবে, শুভ্র হয়তো তাকিয়ে থাকবে টিমটিম আলোয় জ্বলতে থাকা দূরের জাহাজ গুলোর দিকে।
শিমুল নিজেই ভেবে অবাক হয় কাকে নিয়ে সে এত স্বপ্ন দেখে যে সারাক্ষণ অতীতের স্মৃতিতে মাতাল হয়ে থাকে? শিমুলের মন আরও খারাপ হয়ে গেল, গাড়িতে মৃদু তালে মিউজিক বাজছে -
" I am so lonely, Broken Angel
I am so lonely, Listen to my Heart"


শুভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিত্যের দিকে, তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে,
- আপনি এমন করছেন কেন? আমি কি অন্যায় করেছি?
- অন্যায় করেছ মানে? তুমি কাল রাতে কেন আমার বাসায় গিয়েছিলে?
- আমি.... আমি তো নোট দিতে...
আদিত্য শুভ্রর কোন কথাই শুনতে চাইল না,
-সব কিছু হইছে শুধু তোমার জন্য।
- আমার জন্য? আমি তো নিজে থেকে কিছু করিনি, বরং আপনি আমার উপর জোড় করেছেন।
- আমি তো মাতাল ছিলাম, হুস ছিল না, তোমার তো হুস জ্ঞান সব ঠিক ছিল, তুমি বাধা দিলে না কেন? শালা Gay কোথাকার!
- আপনি নিজে কি সেটা একবার চিন্তা করেছেন? মাতাল হয়ে ছেলে মেয়ের পার্থক্য ধরতে পারেন না, অথচ শরীরের কাম বাসনা কিভাবে মেটাতে হয় সেটা ঠিকই জানেন।
শুভ্র কাঁদছে, তার মুখে চড়ের দাগ লাল হয়ে আছে, আদিত্য আর কিছু না বলে চুপচাপ বেড়িয়ে গেল .


আজ প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আদিত্য ভার্সিটিতে যাচ্ছে না। মোবাইল অফ করে রেখেছে, বন্ধু বান্ধব কারো সাথেই কোন যোগাযোগ নেই। সেদিনের শুভ্রর চোখের পানি সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। সত্যিকারে শুভ্রর তো কোন দোষ ছিল না, ঐ রাতে যা কিছু হয়েছে তার জন্য সে নিজেই দায়ী, কিন্তু তার নিজেরও কি খুব বেশী দোষ ছিল? ছোটবেলা থেকে ছেলেদের প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষন অনুভব করত সে, কিন্তু তার এই অনুভূতিকে সে সারাজীবন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু শুভ্রকে দেখার পর তার সব কিছু যেন ওলট পালট হয়ে গেল, শুভ্রর মুখটা সে যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেনা, দিন রাত ২৪ ঘন্টা শুধু তার কথাই ভাবতে ইচ্ছে করে। ভার্সিটিতে আদিত্যের চোখ জোড়া শুধু একটা মুখকেই খুজে ফিরে। যেদিন শুভ্রর সাথে দেখা হয়না, সেদিন তার কোন কিছু ভাল লাগে না, ক্লাস করতে ইচ্ছে করে না, খেতে ইচ্ছে করে না, আগের মত এখন আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতেও ভালও লাগে না। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত সে শুভ্রর প্রেমে পড়েছে? না হলে কেন সে শুভ্রর জন্য এতটা ফিল করছে?
শুভ্রকে খুব মিস করছে আদিত্য, বুকের ভেতর কেমন জানি চিন্‌চিন্‌ করে ব্যাথা করছে তার। শুভ্রর কাছে তাকে ক্ষমা চাইতেই হবে, না হলে সে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবে না .


- আরে আদিত্য ভাই, কেমন আছেন আপনি? গত দুই সপ্তাহ কই ছিলেন? ফাহাদ আদিত্যের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসলো।
- এই তো একটু অসুস্থ ছিলাম।
- তাই তো বলি, আপনাকে ভার্সিটিতে দেখি না কেন?
- ফাহাদ, তুমি কি শুভ্র কে একটু ডেকে দিতে পারবে? ওর সাথে আমার কিছু জরুরী কথা ছিল।
-ঠিক আছে, ভাইয়া, আমি শুভ্রকে এখনই ডেকে দিচ্ছি।
- Thanks ফাহাদ
- আরে ভাই, এর জন্য Thanks বলা লাগে?

আদিত্য সন্ধ্যার পর হলের সামনে সিড়িতে দাড়িয়ে শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করছে। কিভাবে যে শুভ্রকে কথা গুলো বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে, বড্ড অস্থির লাগছে, বাইরের ঠান্ডা বাতাসেও আদিত্যের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
- আপনি আমাকে ডেকেছেন? শুভ্র আদিত্যের সামনে এসে দাড়ালো।
- হ্যাঁ, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।

-আমার সাথে আপনার কি কথা থাকতে পারে? সেদিন সবার সামনে চড় মেরেও সাধ মেটেনি, নতুন করে আবার মারতে এসেছেন?
- শুভ্র, সেদিনের জন্য আমি সত্যি খুব sorry , সেদিন আমার মাথা ঠিক ছিল না, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।
- আমি আপনাকে ক্ষমা করার কে, বলুন? আপনারা সিনিয়র, তাই জুনিয়রদের সাথে যা খুশী তা করার অধিকার আছে।
- প্লিজ, শুভ্র, তুমি জানো না, গত দুইটা সপ্তাহ আমার যে কিভাবে কেটেছে, একটা মুহুর্তের জন্য আমি শান্তি পাইনি।
- so , আমি আপনাকে কিভাবে শান্তি দিবো?

- শুভ্র, please, forgive me.
-আপনি এখন যান, আর নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নাই। আপনি কোনও দোষ করেন নি, সব দোষ আমার, আমি আপনার ফ্লাটে গিয়েছি, আপনি তো আমাকে বলেন নি রাত জেগে আপনার সেবা করতে, যা কিছু হয়েছে আমার কারণে হয়েছে।
-তার মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না?
- বারবার একই কথা কেন বলছেন?
-ওকে, ফাইন, ক্ষমা করা তোমার উপর, কিন্তু যতক্ষণ তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না, আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।
- পাগলের মত কথা বলছেন কেন?
-আমি তো পাগলই।
- আপনার যা খুশী তাই করেন, আমি যাচ্ছি।


রাত প্রায় ১০টা বাজে, আদিত্য হলের বাইরে একা একা দাড়িয়ে আছে, অনেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছে, কেন সে এখানে এত রাতে এভাবে একা দাড়িয়ে আছে? আদিত্যের ভেতর যে একটু পাগলামী স্বভাব আছে এটা ভার্সিটির প্রায় সবাই জানে, তাই কেউ আদিত্যকে নিয়ে খুব বেশী মাথা ঘামাল না। আদিত্য তার সিদ্ধান্তে অটল, শুভ্র তাকে মন থেকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত সে এখান থেকে যাবে না, দরকার হলে সে সারা রাত দাড়িয়ে থাকবে। এম্নিতেও শুভ্রর কাছে তার কিছু শাস্তি পাওনা আছে।
হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হল, অসময়ের বৃষ্টি, বছরের এই সময় সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। ঢালাও বর্ষণ, আদিত্য ভিজছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। ঠান্ডায় তার গা কাঁপছে, তারপরও সে বৃষ্টির ভেতরেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে শুভ্রর অপেক্ষায়। সে জানে শুভ্র আসবে, তাকে যে আসতেই হবে।

৬.
রাত ১১টা . মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, এক মুহুর্তের জন্যও বৃষ্টি থামে নি। শুভ্র জানালার পাশে দাড়িয়ে আদিত্যকে দেখছে, তার খুব ইচ্ছে করছে একটি ছাতা নিয়ে আদিত্যের সামনে গিয়ে দাড়াতে, হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকতে, বৃষ্টির মধ্যে দুজনই একই ছাতার নীচে দাড়াতে, কিন্তু সে জানে এসব পাগলামীর কোন মানে হয়না।
আদিত্যের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে, মানুষটা সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছে, চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছে, নির্ঘাত আবার জ্বর বাঁধাবে, আদিত্যের তো রাতে কিছু খাওয়াও হয়নি, এতক্ষণে নিশ্চয় খুব ক্ষিদে পেয়েছে, এত পাগল কেন মানুষটা, বাচ্চাদের মত জিদ ধরে বসে আছে। শুভ্র নিজেও রাতে কিছু খায়নি, ফাহাদ তাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছিল, কিন্তু তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।


- আপনি এখনো দাড়িয়ে আছেন?
- বলেছি না, তুমি ক্ষমা না করলে আমি কোথাও যাব না।
- আপনি সত্যি একটা পাগল।
- এতক্ষণে বুঝলা
- হ্যাঁ, বুঝেছি, শুভ্র হেসে বললো।
- ক্ষমা করেছ?
- না করে উপায় আছে।
- আরও আগে করলে ভাল হত।
- কেন?
- আমাকে এতক্ষণ দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হত না।
- আপনার এই শাস্তিটুকু পাওয়ার দরকার ছিল
- আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি আনন্দ পেয়েছ?
-তোমার কি মনে হয়?
- জানিনা
- যাও, এখন বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় চেঞ্জ কর, না হলে আবার জ্বর বাঁধাবে।
শুভ্র নিজেও জানে না কখন থেকে সে আদিত্যকে তুমি বলে সম্বোধন করছে, 
শুভ্র বারান্দার ভেতরে দাড়িয়ে আদিত্যের সাথে কথা বলছিল। আদিত্য তার হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে আসলো।
- এখন বুঝ, আমাকে বৃষ্টিতে ভেজানোর মজা।
আদিত্য হাসছে, কি সহজ সরল সেই হাসি।
- শুভ্র, চলো আমার সাথে
- এত রাতে, কোথায়?
- আমার ফ্লাটে, প্লিজ
আদিত্য শুভ্রর দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল, এই হাতের আহবান উপেক্ষা করার শক্তি আজ শুভ্রর নেই, হয়তো কখনোই ছিল না।


আদিত্য শুভ্রকে নিয়ে সোজা তাদের ছাদে চলে আসলো, তাদের ছাদটা খুব সুন্দর, ছাদের মেঝে সাদা মার্বেল পাথরের, ছাদের একপাশে বাগান, পুরো ছাদের রেলিং জুড়েই বিভিন্ন ধরনের লতানো গাছ, ছাদটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়, আবছা আবছা আলো, মুষলধারে বৃষ্টি ,সবকিছু মিলে এক রহস্যময় তৈরী করেছে।
আদিত্য ছাদের দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর শুভ্রর সামনে এসে দাড়িয়ে কাধে হাত রেখে বললো,
-I Love You ,শুভ্র, আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
আদিত্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্র, তারপর আটকে রাখা নিশ্বাস ধীরে ধীরে ছেড়ে বললো,
- তুমি.... আমাকে... সত্যি?
- তুমি জানো সত্যি, তুমি জানো আমরা দুজনই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেছি।
-হ্যাঁ, 
এক অদ্ভুত আনন্দে শুভ্রর হাসতে ইচ্ছে করছে, আবার কাঁদতেও ইচ্ছে করছে।
-শুভ্র, নিজের সাথে আমি অনেক যুদ্ধ করেছি, কিন্তু তোমাকে অগ্রাহ্য করার শক্তি আমার নেই, আজকে সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে জেনে বুঝে বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না, তুমি সামনে আসলে আমি শিহরিত হই, অকারণে সব কিছু ভাল লাগতে শুরু করে, পারবে না এই পাগলটাকে একটু সাম্‌লে রাখতে, তাকে একটু কেয়ার করতে, ভালোবাসতে?
শুভ্র কি বলবে বুঝতে পারছে না,

-তুমি কিছু বলবে না?
- আমার সব কথা তো তুমিই বলে দিয়েছ
শুভ্র আর কিছু না বলে তার ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো আদিত্যের ঠোঁটে, দুজন দুজনের অধরে চুমো খেয়ে চললো অবিরাম ভাবে বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে যেন দুজন তৃষ্ণার্ত পথিক পিপাসার্ত হয়ে পান করছে একে অপরকে, এ যেন কোন যৌনতা নয়, ভালোবাসার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া.
- আজকে সারা রাত এখানেই থাকব, বৃষ্টিতে ভিজব, আদিত্য বললো
- পাগল নাকি, জ্বর বাঁধাবে তো
- জ্বর হলে ক্ষতি কি, এখন তো আমি একা নই, জ্বর হলে তুমি আমার সেবা করবে, আমাকে খাইয়ে দেবে, মাথায় পানি ঢালবে, সারাক্ষণ আমার পাশে বসে থাকবে।
- আর তুমি কি করবে তখন?
- আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে তোমার হাত ধরে শুয়ে থাকব।
- হইসে, চলো প্লিজ
- আমি অনেকক্ষণ ধরে ভিজেছি, এখন আর ঠান্ডা লাগছে না, আজকের রাত আমাদের দুজনের জন্যই অনেক special। এই রাতে ঘুমালে চলে, বলো?

বৃষ্টির বেগ এখন অনেকটাই কমে এসেছে, ঝিরি ঝিরি করে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে, আদিত্য তার পরনের জিনস, শার্ট সব খুলে ফেললো, ভেজা কাপড় অনেকক্ষণ শরীরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে, আদিত্যের পরনে শুধু একটা কালো রঙ্গের বক্সার, শুভ্রকেও কাপড় খুলতে সাহায্য করলো, দুজনই অর্ধনগ্ন হয়ে বৃষ্টির মধ্যে শুয়ে পড়েছে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনুভব করছে শরীরের প্রতিটি লোম কূপ দিয়ে, খুজে নিচ্ছে আদিম উষ্ণতা। একে অপরের সারা শরীরে চুমো খেয়ে যাচ্ছে। আজ কোনও যৌনতা নয়, ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, চিনে নিচ্ছে পরষ্পরের দেহের মাদকতাময় গন্ধ, চুমো দিয়ে একে দিচ্ছে পরষ্পরের শরীরে ভালোবাসার সাক্ষর।
এক হয়ে গেছে দুটো শরীর, সময় থমকে গেছে, স্থির হয়ে গেছে পৃথিবী, যেন এই পৃথিবীতে তারা দুজন ব্যাতিত বাকী অন্য কিছুর কোনও অস্তিত্ব নেই।

৯.
- শুভ্র, আর কতক্ষণ ধরে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো, রাত প্রায় ১২টা বাজে।
- আমার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না শিমুল.
- কিন্তু তাই বলে কতক্ষণ এভাবে গাড়ি নিয়ে 
বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় ঘুরবো? কাল আমার অফিস আছে, শুভ্র
- আমার কিছু ভাল লাগছে না, শিমুল
- আমি তোমাকে বুঝি, শুভ্র, কিন্তু নিজেকে একটু সাম্‌লাও, সব কিছু ভুলে যেতে চেষ্টা কর, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-শিমুল , ব্রীজের উপর গাড়িটা একটু সাইড করে রাখ তো
- কই যাবে, এই বৃষ্টির মধ্যে?
- আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে।
- আমার শরীর ভালো না, আমি ভিজব না
-ওকে, তুমি গাড়ির ভেতরে বসে থাক, আমি নামবো।
- ঠিক আছে, আমিও আসছি
-না, তোমাকে যেতে হবে না, আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লিজ

১০.
শুভ্র ব্রীজের রেলিং এর উপর দাড়িয়ে আছে, আজ তার জীবনের একটি বিশেষ রাত, এই রাতেই তো আদিত্য ভালোবেসে শুভ্রর হাত ধরে ছিল, সারা জীবন পাশে থাকার অংগীকার করে ছিল, আজ শুভ্র ও আদিত্যের ভালোবাসার ৩য় বর্ষপূর্তি।
আজও তুমুল বর্ষণ হচ্ছে, আজও শুভ্র বৃষ্টিতে ভিজছে, কিন্তু আজ আদিত্য তার পাশে নেই, আজ সে একা। সময়ের আবর্তনে পাল্টে যায় জীবনের দৃশ্যপট, শুধু রয়ে যায় স্মৃতি, নিভে যাওয়া আগুনের অবহেলিত ভস্মীভূত সাদা ছাইয়ের মত।
শুভ্র কাঁদছে, চিৎকার করে কাঁদছে, বুক ভাঙ্গা কষ্ট বের হয়ে আসছে মনের গহীন থেকে, আজ প্রকৃতিও কাঁদছে শুভ্রর সাথে তাল মিলিয়ে, শুভ্রর কান্নার শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দে, বৃষ্টির জলে মিলে মিশে একাকার হচ্ছে চোখের পানি।
শিমুল আজ পর্যন্ত শুভ্রর বয়সী কোন ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি, তার খুব ইচ্ছে করছে শুভ্রর পাশে দাড়িয়ে তার কাধে হাত রাখতে, ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে বলতে " প্লিজ, তোমার কষ্টগুলো আমাকে দাও, তোমাকে এত কষ্ট পেতে দেখে আমার যে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে"

কিন্তু শুভ্রর এই কষ্টের জগৎটা তার একার। শিমুল কখনো সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।
কাঁদুক শুভ্র , কেদে তার বুকের গভীরে জমে থাকে কষ্ট গুলোকে ভাসিয়ে দিক বৃষ্টির জলে।
শিমুলও গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাড়িয়ে একা একা ভিজছে, কেন জানি তার চোখও জলে ভরে উঠছে। তখনি সে সিদ্ধান্ত নিলো শুভ্র না চাইলেও তাকে জোড় করে চট্টগ্রাম নিয়ে যাবে, একবারের জন্য হলেও সে শুভ্রকে আদিত্যের সামনে দাড় করাবে , কারণ শিমুল জানে ঠিক এই মূহুর্তে আরও একজন শুভ্রর মত বৃষ্টির মাঝে তার ভালোবাসার মানুষকে খুজে ফিরছে। 

Every night in my dreams
I see you, I feel you,
Near, far, where ever you are
I believe that my heart does go on.
Love can touch us one time,
And last for a life time.
Once more you open the door,
And you are in my heart
And my Heart will go on and on

**************
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?

আমাদেরও কিছু গল্প আছে। শোনার মত মানসিকতা কি আছে তোমার?